কুয়েট: উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশন শুরু

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছেন।
সোমবার (২১ এপ্রিল) বিকেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে কিছু শিক্ষার্থী তাদের পূর্বনির্ধারিত অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। এর আগে রোববার তারা ভিসির পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। আল্টিমেটামের সময়সীমা শেষ হলেই তারা অনশনে বসেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিকেলে শিক্ষার্থীরা ড. এম এ রশীদ হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন। সেখান থেকে তারা তোশক, বালিশ, বিছানার চাদর নিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে গিয়ে বসে পড়েন।
এর আগে থেকেই সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক, সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক অবস্থান করছিলেন। শিক্ষার্থীরা আসার পর শিক্ষকরা তাদের কাছে যান।
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের এক দফা দাবিতে অনড় রয়েছেন। ভিসির পদত্যাগ ছাড়া তারা আন্দোলন থেকে পিছু হটবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রদল ও বহিরাগতরা গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হামলা চালালেও উপাচার্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে একজন বাইরের ব্যক্তি আদালতে মামলা করেছেন।
তারা অভিযোগ করেন, হামলাকারীদের বদলে আন্দোলনকারী ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপাচার্য অপসারণের দাবি জানানো হলেও তারা কোনো সুফল পাননি। তাই বাধ্য হয়ে তারা আমরণ অনশনে বসেছেন।
তারা বলেন, তাদের এক দফায় যেতে হয়েছে কারণ তারা শঙ্কিত — 'যে ভিসি আন্দোলন নস্যাৎ করতে তাদেরকে বহিষ্কার করতে পারেন, সে ভিসির সঙ্গে আপোষ করলে ভবিষ্যতে তাদের নিরাপত্তা কোথায়?'
দুই মাসেও অধিকাংশ দাবি পূরণ হয়নি জানিয়ে তারা বাকি দাবিগুলো কিভাবে পূরণ হবে সে প্রশ্ন তোলেন। 'আমরা বিশ্বাস করি, ভিসি আমাদের দাবি পূরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ। তাই তার পদত্যাগ অবধারিত,' বলেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
তারা আরও বলেন, 'আমরা বিস্মিত যে ১৮ তারিখের হামলাকে তদন্ত কমিটি "সংঘর্ষ" বলছে। এটা কি আসলেই সংঘর্ষ? আর কমিটি ১৮ তারিখের ঘটনা তদন্তের জন্য হলেও এখন ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারির কথা বলছে কেন?'
তদন্ত কমিটি ও সিন্ডিকেট ছাড়া ক্যাম্পাসের সিসিটিভি ফুটেজ বটপেইজে [ফেসবুক পেইজ] কিভাবে গেল? তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই নিয়ম ভেঙে প্রমাণ সন্ত্রাসীদের হাতে দিয়েছে? — প্রশ্ন তোলেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে সোমবার দুপুর ১২টায় স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার সেন্টারে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ব্রিফ করেন ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার।
তিনি বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং তাদের একটি অংশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
আলোচনায় শিক্ষার্থীদের জানানো হয়, সাময়িক বহিষ্কৃত ৩৭ শিক্ষার্থীর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলার ব্যাপারেও প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে।
তিনি দাবি করেন, অন্যান্য দাবির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে এবং তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধের আহ্বান জানান।
তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, 'নতুন ছাত্র কল্যাণ পরিচালক স্যার যোগ দিয়েছেন বলে আমরা দেখা করতে গিয়েছিলাম। তবে ওরকম কোনো আলোচনা হয়নি। স্যারের রুমে গিয়ে শুধু দেখা করে চলে এসেছি।'
প্রেক্ষাপট
১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।
পরদিন শিক্ষার্থীরা সব একাডেমিক ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। ওই দিন সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
সে রাতেই তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং থানায় অজ্ঞাত ৪০০–৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
২০ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সকল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে 'লাল কার্ড' দেখান। একই সঙ্গে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানান।
২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনা থেকে ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। এতে হামলার বিচার, ভিসির পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি তোলা হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি কুয়েটের ৯৯তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
গত ১৪ এপ্রিল বিকেলে কুয়েটের ১০১তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কুয়েটের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা শাহেদুজ্জামান শেখ জানান, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯৮তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তাদের দেওয়া সিলগালা প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে উপস্থাপন ও গ্রহণ করা হয়। এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটিতে বিষয়টি প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে ৪ মে থেকে ক্লাস শুরুর এবং ২ মে থেকে সব আবাসিক হল শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
এছাড়া গত ১০ এপ্রিল কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে খুলনার এক বাসিন্দা হোচেন আলী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন।
আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে খানজাহান আলী থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আরজিতে বলা হয়, ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হোচেন আলী কুয়েট রোড দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পকেট গেটের সামনে আসামিরা তাকে রড ও লাঠি দিয়ে মারধর করে এবং সোনার চেইন ছিনিয়ে নেয়।
তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া একজন বাইরের ব্যক্তি ২২ জন শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় জানতেই পারতেন না।
তারা মনে করেন, প্রশাসনই এ মামলার পেছনে উসকানিদাতা।