তিন মাসে ২৪ দুর্ঘটনা: ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে কেন দুর্ঘটনার হটস্পট হয়ে উঠছে

ঘটনাটি গত ১৭ এপ্রিল রাতের। 'বরিশাল এক্সপ্রেস' নামের একটি বাস সেদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৬০ জন যাত্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
এর ঘণ্টাখানেক পর বাসটি ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের কামারখোলা সেতুতে উঠলে একটি কাভার্ডভ্যানের পেছনে জোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসটির ছাদ সামনে থেকে ভেঙে পেছনে গিয়ে আটকে থাকে।
দুর্ঘটনার পরও চালক বাসটি না থামিয়ে আরও দ্রুতগতিতে চালাতে থাকেন। পরে ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে সমষপুরে বাসের ছাদটিই উড়ে যায়। তবুও বাস চালিয়ে যেতে থাকেন চালক। সমষপুর পেরিয়ে আরেকটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয় বাসটি। তারপরও চালক বাসটি বেপরোয়াভাবে প্রায় ছয় কিলোমিটার চালিয়ে যান।
এ সময় বাসের যাত্রীদের চিৎকার শুনে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ বাজারে স্থানীয় জনতা বাসটি আটক করে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান হাইওয়ে পুলিশ ও শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ততক্ষণে পালিয়ে যান বাসচালক। আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে নেওয়া হয় হাসপাতালে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা যা বলছেন
কুমারভোগ বাজার এলাকায় কথা হয় ৭০ বছর বয়সি স্থানীয় বাসিন্দা কবির হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঘটনার বর্ননা দিয়ে টিবিএসকে বলেন, 'আমার জীবনে এমন ঘটনা দেখিনি। বাসের ছাদ উড়ে গেছে তবুও এতটা পথ চালক কীভাবে চালিয়ে এল? আমরা যাত্রীদের চিৎকার শুনে এসে বাজারে শেষ মাথায় বাসটি আটকাই। চালক মনে হয় নেশাগ্রস্থ ছিলেন, না হলে কীভাবে এই কাজ করলেন?'
তিনি আরও বলেন, যাত্রীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ই ছিলেন। ভাঙা কাঁচের আঘাতে তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যা জানা গেল
বরিশাল এক্সপ্রেস বাসটির কাউন্টার রয়েছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। সেখানে গিয়ে কথা হয় বাসটির কাউন্টার ম্যানেজার মো. বদরুল আলমের সঙ্গে।
তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে চালক পলাতক রয়েছেন। ঢাকা থেকে বরিশাল, বরগুনা রুটে তাদের ৮টি বাস চলে। তবে সেদিন এমন ঘটনা কেন ঘটেছে সেটা তারা কেউই জানেন না।
কেন এত দুর্ঘটনা
ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কেন এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে কেন- জানতে চাইলে ওই রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা জানান, মূলত বাসচালকদের বেপরোয়া গতির কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে।
বরিশালের মো. শামীম মিয়া নামের এক বাসযাত্রী সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার পর থেকেই বাসচালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। কে কার আগে যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এ কারণে এই রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা সবসময় আতঙ্কিত থাকেন। বাসের চালককে বার বার বললেও তারা শোনেন না।'
অন্যদিকে বাসচালকদের অভিযোগ- যাত্রীদের চাপের কারণেই তারা বেপরোয়া গতিতে বাস চালাতে বাধ্য হন।
লতিফ বিশ্বাস নামের এক বাসচালক বলেন, 'সব সময় শুধু ড্রাইভারদেরই দোষারোপ করা হয়। কোনো দুর্ঘটনা হলেই সবাই চালককে পিটুনি দেয়। কার দোষ সেটা কেউ বিচার করতে চায় না। এসব ভয়ের কারণে বরিশাল এক্সপ্রেসের ওই ড্রাইভার সেদিন হয়তো গাড়ি দাঁড় করাতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তবে ছাদ উড়ে যাওয়ার পর তার অবশ্যই উচিত ছিল গাড়ি থামানো।'

যাত্রীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'যাত্রীরাও বার বার বলে জোরে চালান, পেছনের বাস আগে চলে গেল কেন। বাড়িতে পৌঁছাতে হবে তাড়াতাড়ি। এমন নানা রকমের কথা বলে চালককে জোরে গাড়ি চালাতে বাধ্য করে অনেক যাত্রী।'
বাসমালিক ও চালককে বিআরটিএ কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ
ছাদ উড়ে যাওয়া সেই বাসটি আটক করে রেখেছে শ্রীনগরের হাসাড়া হাইওয়ে থানা পুলিশ। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। বাসটির নিবন্ধন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
একইসঙ্গে বাসটির মালিককে নিবন্ধন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ট্যাক্স-টোকেন সনদ এবং চালকের লাইসেন্সসহ বিআরটিএর কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় বাসটির নিবন্ধন সনদ স্থায়ীভাবে বাতিল এবং মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করেছে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ।
বিআরটিএর উপপরিচালক সানাউল হকের সই করা এক চিঠিতে এসব কথা বলা হয়েছে। বাসটির নিবন্ধন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৯৩৫০।
গত তিন মাসে যত দুর্ঘটনা ও মৃত্যু
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, বিগত তিন মাসে ঢাকা মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ২৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন। আহত হয়েছেন অনেকেই।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জিলানী টিবিএসকে বলেন, 'জানুয়ারিতে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১০টি। এতে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। ফেব্রুয়ারিতেও ১০ দুর্ঘটনায় ৫ জন মারা গেছেন। গত মার্চ ও চলতি এপ্রিলের ১৫ তারিখ পর্যন্ত আরও ৩টি দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।
গতি নিয়ন্ত্রণে ক্যামেরার সঠিক ব্যবহার ও সন্ধ্যার পর বাইক চলাচল সীমিত করাসহ কিছু কার্যকারী পদক্ষেপ নিলেই কমতে পারে এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনা- এমন দাবি পুলিশের এই কর্মকর্তার।