ঢাকায় বিমান বিধ্বস্ত: ‘এমন শব্দ আগে শুনিনি—তারপরই মাথার উপর দিয়ে যুদ্ধবিমানটি উড়ে গেল’

'আকাশ থেকে যেন ৩০-৪০টা বজ্রপাত একসঙ্গে পড়েছিল' গত ২১ জুলাই রাজধানী উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপর বিমান বিধ্বস্তের ভয়াবহ ঘটনা স্মরণ করে বলছিলেন ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী আহনাফ বিন হাসান। দুর্ঘটনার দুদিন পরও বিবিসিকে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কাঁপছিল আহনাফের।
আহানফ বলেন, 'আমি জীবনে কখনও এমন শব্দ শুনিনি। চোখের পলকে সেই যুদ্ধবিমানটা আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্কুল ভবনে আছড়ে পড়ে।'
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান গত সোমবার (২১ জুলাই) আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি শাখার ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।
ঘটনায় কমপক্ষে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের অনেকেই ছিলেন ১২ বছরের নিচের স্কুলশিক্ষার্থী। কেউ ছিলেন অভিভাবকের জন্য অপেক্ষায়, কেউ যাচ্ছিলেন কোচিং ক্লাসে, আবার কেউ কেউ বের হয়েছিলেন হালকা খাবার কিনতে।
বিশাল ১২ একর ক্যাম্পাসের একটি ছায়াঘেরা জায়গায় চকোলেট রঙের বাদামি শার্ট, কালো প্যান্ট, আর গায়ের ব্যাজ গুছিয়ে পরা আহনাফ কথা বলছিলেন এক বন্ধুর সঙ্গে।
তিনি জানান, মাত্র ৩০ ফুট দূরেই যুদ্ধবিমানটি হঠাৎ নাকের ডগায় আছড়ে পড়ে ভবনে বিধ্বস্ত হয়।
আহনাফ সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং মাথা ঢেকে ফেলেন হাতে। চোখ খুলতেই দেখেন, চারপাশের দৃশ্য বদলে গেছে।

বিবিসিকে তিনি ফোনে বলেন, 'চারদিকে শুধু ধোঁয়া, আগুন আর অন্ধকার। শিশুরা চিৎকার করছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।'
বিমানবাহিনী জানায়, প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে থাকা যুদ্ধবিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়েছিল। পাইলট শেষ মুহূর্তে বের হয়ে আসলেও পরে হাসপাতালে মারা যান।
আহনাফ বলেন, 'আমি পাইলটকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। দুর্ঘটনার পর মাথা তুলে দেখি তার সাদা প্যারাসুট ধীরে ধীরে নিচে নামছে। তিনি একটি টিনশেড ভবনের ছাদ ভেঙে পড়েন। শুনেছি, নামার পরও তিনি জীবিত ছিলেন, এমনকি পানি চেয়েছিলেন। পরে একটি হেলিকপ্টারে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।'
স্কুলজুড়ে ধোঁয়া আর আগুন ছড়িয়ে পড়ার সময় আহনাফের ভেতরের সাহসী সত্তা জেগে ওঠে। জ্বলন্ত বিমানের একটি খণ্ডাংশ তাঁর স্কুলব্যাগে আঘাত করে, প্যান্টে আগুন ধরে যায়, হাত পুড়ে যায়। তিনি বলেন, 'তাপটা ছিল ভয়ানক, কিন্তু আমি ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে যাই সাহায্য করতে।'
তিনি দৌড়ে যান সেই কংক্রিটের পথ ধরে, যা খেলার মাঠকে দুইতলা প্রাইমারি স্কুল ভবন থেকে আলাদা করেছে। বিমানটি স্কুলের গেটে সজোরে ধাক্কা মেরে ছয় থেকে সাত ফুট গভীরে মাটিতে ঢুকে পড়ে, তারপর কাত হয়ে প্রথম তলায় আছড়ে পড়ে এবং বিস্ফোরিত হয়। 'ক্লাউড' ও 'স্কাই' নামে দুটি শ্রেণিকক্ষ ছিল দুর্ঘটনার মূল কেন্দ্রে।

প্রবেশপথের কাছে আহনাফ দেখেন এক শিক্ষার্থীর ছিন্নভিন্ন মরদেহ।
তিনি বলেন, 'দেখে মনে হচ্ছিল, বিমানটি ভবনে আঘাত করার আগে তাকে আঘাত করেছে। সে আমাদের চেয়েও ছোট ছিল।'
সাধারণত শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখর থাকা পাঁচ ভবনের ক্যাম্পাসটি মুহূর্তেই রূপ নেয় ধোঁয়া, আগুন, বিকৃত ধাতব খণ্ড আর আর্তনাদে ভরা বিভীষিকাময় এক চিত্রে।
ধোঁয়ার মধ্যে আহনাফ দেখতে পান এক জুনিয়র শিক্ষার্থীকে। তার শরীর ঝলসে গিয়েছিল, আর আগুন থেকে তাকে টেনে বের করেছে তার আরেক বন্ধু।
আহনাফ বলেন, 'তার বন্ধু আমাকে বলল, "আমি একা পারছি না। তুমি কি সাহায্য করবে?" তাই আমি ছেলেটিকে তুলে কাঁধে তুলে নিয়ে যাই মেডিক্যাল রুমে।'
আরেকজন নারী আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীরা কাপড় ছাড়া শুধু অন্তর্বাস পরে ভবন থেকে দৌড়ে বের হচ্ছিল, কারণ তাদের পোশাক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তীব্র তাপে ত্বক ঝলসে গিয়েছিল।
আহনাফ আরও বলেন, 'দ্বিতীয় তলায় শিক্ষার্থীরা আটকা পড়ে চিৎকার করছিল। আমরা একটি গ্রিল ভেঙে একটা গেট খুলতে সক্ষম হয়েছিলাম, যা আগুনে ভস্মীভূত ছিল। তারপর সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস এসে কিছু শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে।'
আহনাফ, অনেকের মতো, নিজের বয়সের বাইরে দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেন দ্রুত।
আহনাফ আরও বলেন, 'আমরা জনসাধারণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছিলাম, সবাইকে আগুন থেকে দূরে রেখেছিলাম। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য রাস্তা খালি করেছিলাম এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ক্যাম্পাসে তাদের পাইপ সরাতে সাহায্য করেছিলাম।'

এক সময়ে তিনি নিজের শার্টটাও খুলে দেন। তিনি বলেন, 'একজন শিক্ষার্থীর কাছে কোনো পোশাক ছিল না। আমি আমার ইউনিফর্ম খুলে তাকে দিয়েছিলাম। তারপর আমি শার্ট ছাড়াই উদ্ধার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম।'
তবে স্কুলে এত তরুণ প্রাণ হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়া কঠিন হবে বলে জানান আহনাফ। তাদের একজন ছিলেন ১১ বছর বয়সী ওয়াকিয়া ফিরদৌস নিধি।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও স্কুলে গিয়েছিল নিধি। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার সময় তার বাবা নামাজ পড়ছিলেন। খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিধির বাবা মোসলেম খালি পায়েই মেয়ের খোঁজে দৌড়ে এসেছিলেন।
তার চাচা সাইয়েদ বিল্লাল হোসেন বলেন, পরিবার পুরো রাত ধরে ছয়টিরও বেশি হাসপাতালে ওর খোঁজাখুঁজি করেছিল।
বিল্লাল হোসেন বলেন, 'আমরা উত্তরা জুড়ে ঘুরেছিলাম। কেউ বলল, এক হাসপাতালে ছয়টি মরদেহ আছে। মঙ্গলবার ভোর একটায় তার বাবা ওকে চিনে নেন—তার দাঁত ও চোখের এক সমস্যার মাধ্যমে। কিন্তু এখনও মরদেহ আমাদের হাতে আসেনি।'
এমন প্রশাসনিক জটিলতা সন্তান হারানোর বেদনাকে আরও কেবল বাড়িয়েই তুলছিল।
দাঁত ও চোখের লেন্সের মাধ্যমে মেয়ে নিধিকে শনাক্ত করার পরও পরিবারকে জানানো হয়, একাধিক দাবি থাকায় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না।
প্রথমে একটি পুলিশ রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছে। এরপর বাবা সামরিক হাসপাতালে রক্ত দিয়েছেন। এখন মায়ের নমুনা নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। হোসেন বলেন, 'আমরা জানি এটা ওই মেয়েটি। তবুও মরদেহ আমাদের হাতে দেওয়া হচ্ছে না।'
নিধি তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, এবং দিয়াবাড়ির পুরোনো বংশীয় বাড়িতে তার চাচার বাড়ির পাশে থাকত। হোসেন বলেন, 'সে আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে—ছাদে খেলত, বাড়ির পাশের নারিকেল গাছের নিচে বসত, সবসময় তার বোনের ছোট মেয়ে কে আদর করত। সে ছিল একটি শিশু, আর শিশুদের ভালোবাসত।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি তাকে আগের দিনই দেখেছিলাম। যদি ওই দিন কোচিং ক্লাসে না যেত, হয়ত সে বেঁচে থাকত।'
দুর্ঘটনার পরের বিশৃঙ্খলা আর হৃদয়বিদারক মুহূর্তগুলোর মাঝেও ছিল অসাধারণ সাহস আর গণ্ডি ছুঁয়ে যাওয়া বেঁচে যাওয়ার গল্প।
একজন মা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ওই সকালে সে বাচ্চার জন্য টিফিন না দিয়ে টাকা দিয়েছিল খাবার কিনতে। বিরতির সময় সে খাবার কেনার জন্য বের হয়েছিল—এভাবেই অজান্তে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। 'সে বেঁচে আছে কারণ আমি তাকে টিফিন দিইনি,'—বলেছিলেন মা।
আরেকজন বাবার শোক অকল্পনীয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি দুটো সন্তানকে হারিয়েছেন। প্রথমে মেয়ে মারা গেল। মেয়ে কে দাফন করার পর হাসপাতালে ফিরে এলেন, তখন শুনলেন তার ছোট ছেলেও মারা গেছে।
আর ছিলেন মাহরিন চৌধুরী। ক্লাস ৩ থেকে ৫ এর শিক্ষার্থীদের দায়িত্বে থাকা সেই শিক্ষক। তিনি অন্তত ২০ জন ছাত্রছাত্রীকে আগুন থেকে বাঁচিয়েছিলেন।
নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভেবে বারবার আগুনের মধ্য ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। এর ফলে তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি পুড়ে যায়। মাহরিন চৌধুরী একজন নায়ক হয়ে প্রাণ হারালেন।
স্কুলের কর্মীদের জন্য দিনটি যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো।
৪৩ বছর বয়সী বাংলা বিষয়ের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম তুলতুল বলেন, 'আমি আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছি না। প্রতি বার স্কুলের ভবনের দিকে তাকালে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমি হারিয়ে গেছি, অসুস্থ বোধ করি আর হতাশায় ডুবে আছি। আমি তিনজন পরিচিত মানুষকে হারিয়েছি তাদের মধ্যে একজন আমার সহকর্মীর।'
ঘটনার পর হতাহতের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
সরকার ২৯ জন নিহত এবং ১০০-এর বেশি আহতের কথা জানিয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজনকে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে সামরিক বাহিনীর ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স (আইএসপিআর) নিহতের সংখ্যা ৩১ জানায়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনা ও উদ্ধারকাজে মোট ৬৯ জন আহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৪১ জনই ছাত্রছাত্রী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়াল করার অভিযোগ নিয়ে জোর আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। একই সময়ে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক খাদিজা আখতার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে এখনও পাঁচজনের খোঁজ মেলেনি বলে পরিবারগুলো জানাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও বেঁচে যাওয়া মানুষদের কাছে ট্রমার ছাপ এখনও স্পষ্ট।
আহনাফ বলেন, 'আমি দুইদিন ধরে ঘুমাইনি। প্রতি বার বাইরে তাকালে মনে হয় যেন একটি যুদ্ধবিমান আমার দিকে আসছে। চিৎকার এখনও কানে বাজে।'
স্কুলটি ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় যুদ্ধবিমান এবং বাণিজ্যিক বিমানগুলো প্রায়ই ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে উড়ে যায় বলে জানান আহনাফ।
তিনি বলেন, 'আমরা উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু কখনও কল্পনাও করিনি যে কোনও একটি আকাশ থেকে পড়ে আমাদের ওপর আছড়ে পড়বে।'
সেই দিনের আতঙ্ক তাকে অবিরত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। চিৎকার, আগুন আর পুড়ে যাওয়া সহপাঠী ও শিক্ষকদের মরদেহ তার চোখের সামনে থেকে মুছা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'আমি যখন চোখ বন্ধ করি, তখন অন্ধকার দেখতে পাই না—দেখি শুধু ধোঁয়া।'