ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক: বিভাজক কেটে অবৈধ ক্রসিং, বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার সময় মাঝখানে বিভাজক রাখা হয়েছিল যেন মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি কমে। কিন্তু গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনেক এলাকায় স্থানীয় লোকজন ওই বিভাজক ভেঙে ইউ-টার্নের রাস্তা বানিয়ে ফেলেন। অনেক ঘুরে না গিয়ে সহজে রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে তারা এই অবৈধ কাজটি করেন।
তবে এই ধরনের বেআইনি কাজ একাধিক স্থানে হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, তিনি এসব অবৈধ ইউ-টার্ন সম্পর্কে জানেন না। তিনি বলেন, 'বৈধ ইউ-টার্নের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ও শৃঙ্খলা আছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অবৈধ ক্রসিংয়ের সন্ধান পেলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।' তিনি এই এলাকায় কতগুলো বৈধ ইউ-টার্ন আছে তাও বলতে পারেননি।
এই বিষয়ে কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার খায়রুল আলমের মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি ফোনে বলেন, তিনি প্রশ্নটি বোঝেননি। বারবার জিজ্ঞেস করলেও তিনি চুপ ছিলেন। পরে আবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে অনেক জায়গায় অবৈধ ইউ-টার্ন তৈরি হয়েছে। শুধু নন্দনপুর থেকে সুয়াগাজী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় কমপক্ষে ১২টি অবৈধ ইউ-টার্ন আছে। দাউদকান্দি ও চৌদ্দগ্রাম এলাকায়ও অনেক ইউ-টার্ন দেখা গেছে।
এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্ঘটনার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সুয়াগাজীর বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, 'মানুষ নিজেরাই বিভাজক কেটে রাস্তা বানায়। আমাদের বাজারের পাশেই এমন দুইটা রাস্তা আছে। আমি নিজের চোখে অন্তত ৫০টা দুর্ঘটনা দেখেছি।' তিনি জানান, এক কিলোমিটার দূরে একটি বৈধ ইউ-টার্ন আছে। সবাই যদি সেটা ব্যবহার করত, দুর্ঘটনা কমে যেত।
আরেক বাসিন্দা আলম মিয়া বলেন, 'কয়েকবার অফিসাররা এসে সব দেখেছেন, কিন্তু কিছু করেননি।' দাউদকান্দির জিংলাতলীর বাসিন্দা এম এ হানিফ বলেন, 'একবার এক সিএনজি অবৈধ ইউ-টার্ন দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বাস ধাক্কা মারে। তখন তিনজন মারা যান। এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই হয়।'
কোথায় কোথায় এসব ইউ-টার্ন

এসব অবৈধ ইউ-টার্ন সাধারণত বাজার, পেট্রোল পাম্প ও হাইওয়ের পাশে সংযোগ রাস্তাগুলোর কাছে করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি হলো:
- দাউদকান্দি: শহীদনগর, আমিরাবাদ, গৌরীপুর, এলিয়টগঞ্জ
- চান্দিনা: মাধাইয়া, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড
- বুড়িচং: নিমসার, কলাকচুয়া, সৈয়দপুর
- সদর দক্ষিণ: বেলতলী, নলচর, চুয়ারা রোড, চাষিপাড়া সিএনজি ফিলিং স্টেশন, লালবাগ, সুয়াগাজী
- চৌদ্দগ্রাম: মিয়া বাজার
কিছু জায়গায় বিভাজক পুরোপুরি তুলে ফেলা হয়েছে। কোথাও আবার আধাপাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে, যেখানে বড় গর্ত আছে—যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বুড়িচংয়ের সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা দুলাল উদ্দিন বলেন, এসব রাস্তা নতুন করে কাটা হয়েছে, কিছু আবার বহু আগের। তবে সড়ক সংস্কার হলেও এসব রাস্তা ঠিক করা হয় না।
কারা এসব ক্রসিং বানাচ্ছেন

স্থানীয়দের মতে, এসব অবৈধ রাস্তা বানাতে চালক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষই এগিয়ে আসেন। পরিবেশবিদ মতিন সৈকত বলেন, 'ফুটওভার ব্রিজ সবার জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের অনেক সময় সিএনজি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। কেউ কেউ দূরের বৈধ ইউ-টার্ন ব্যবহার করতে চান না। আবার কেউ কেউ পুলিশ এড়াতে অবৈধ রাস্তা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে বড় দুর্ঘটনা হয়।'
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় চালক ও ব্যবসায়ীরা বিভাজক কেটে ফেলেন, যাতে গাড়ি ঘোরাতে সুবিধা হয়। এতে যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি দুই-ই বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, 'মহাসড়কে ধীরগতির যান না উঠলেই নিরাপদ থাকে। আর মহাসড়কে গাড়ির স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে হলে আইন মানা এবং কড়া নজরদারি দরকার।'
তিনি বলেন, 'সড়ক বিভাগ চাইলে এসব অবৈধ ইউ-টার্ন বন্ধ করতে মাঝখানে কংক্রিটের জার্সি ব্যারিকেড বসাতে পারে, যাতে কেউ সহজে উঠতে না পারে। আবার ধীরগতির যানবাহনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও দরকার।'
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, 'সরকার চাইলে এসব বন্ধ করা যায়। সড়ক বিভাগ বা হাইওয়ে পুলিশ—কেউই দায় এড়াতে পারে না। এখন ব্যবস্থা না নিলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।'