৯০ দিনের স্থগিতাদেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক জটিলতার সমাধান চান ব্যবসায়ীরা

শুল্ক ও করের পাশাপাশি ল্যাব টেস্ট, পণ্য পরিবহনে সময়ক্ষেপণসহ নন-ট্যারিফ বাধাও বাণিজ্যের পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
রোববার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক প্রাতরাশ সভায় তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ৯০ দিনের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিতের সময়ের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, "৯০ দিনের মধ্যে যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির পুরো মৌসুম হারাবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক বিষয়ে উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরার জন্য এ সভা আয়োজন করে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম)।
সভায় মূল প্রবন্ধে নাসিম মঞ্জুর বলেন, "আমাদের রপ্তানির বেশিরভাগ পণ্যই মৌসুমভিত্তিক। এই ৯০ দিনের সময়সীমা তখন শেষ হবে, যখন বছরের সবচেয়ে বড় অর্ডার নেওয়ার সময়। তার আগেই যদি পণ্যের দাম নির্ধারিত না হয়, তাহলে পুরো মৌসুমের অর্ডার হারানোর ঝুঁকি থাকবে, যা অনেক কারখানাকে দেউলিয়া করে দিতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "অশুল্ক (নন-ট্যারিফ) বাধা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। সম্ভবত আমরাই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে খাদ্যপণ্য আমদানিতে এখনও বাধ্যতামূলক রেডিয়েশন বা বিকিরণ পরীক্ষা চালু আছে। এ ধরনের পরীক্ষা করতে গিয়ে সময় ও অর্থ অপচয় হয়, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধেই চাপে।"
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির বলেন, "তিন মাসের স্থগিতাদেশ চলাকালেও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বলবৎ আছে। বেশিরভাগ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এই করের বোঝা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে বলছে। আর ৩৭ শতাংশ শুল্ক ফেরত এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।"
তিনি বলেন, "আমাদের কারখানাগুলো এমনভাবে চলে যে তিন–ছয় মাস রপ্তানি বন্ধ থাকলে টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই ৯০ দিনের প্রতিটি দিন কাজে লাগাতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা জরুরি।"
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিচালক আবু মোখলেস আলমগীর হোসেন বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার দিকেও ভাবা যেতে পারে।"
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, "আমরা সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করতে চাই। তবে এ তুলার দাম ও পরিবহন ব্যয় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি, যা আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা না দেয়, তবে অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা দিতে পারে। সরকারকে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দরকষাকষি করতে হবে।"
সভায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জন ফে বলেন, "শুল্ক ইস্যুতে সাধারণ অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই। বিষয়টি দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই পরিষ্কার হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে শুধু আমদানি শুল্কই নয়, সম্পূরক শুল্কও খুব বেশি। প্রযুক্তিপণ্য ও কোল্ডচেইনসহ বিভিন্ন খাতে এ সমস্যা আছে। অশুল্ক বাধার বিষয়েও সমস্যা রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য বাণিজ্য কঠিন করে তুলেছে।"
তিনি বলেন, "৯০ দিন খুব বেশি সময় নয়। শুধু আলোচনা করলেই হবে না, এর মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য অবশ্যই বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"
সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা জানান, পরীক্ষাগারের সংখ্যা কম থাকায় ল্যাব টেস্ট করতে গিয়ে ৩–৪ দিন লেগে যায়। সরকারি ছুটিতে ৮–১০ দিনও সময় লাগে, ফলে আমদানির সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়ে যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের সদস্য বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর কী কী পণ্য আমদানি করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন কোম্পানির পণ্য অন্য দেশে উৎপাদিত হলেও সেগুলো বাংলাদেশে আমদানি হয়। এসব ক্ষেত্রে যদি ইনভয়েসে যুক্তরাষ্ট্রকে অরিজিন দেশ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, তাহলে আমদানির পরিমাণও বাড়বে।"
স্বাগত বক্তব্যে অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক প্রসঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশে শুল্কের চেয়ে অশুল্ক বাধা বেশি। আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছাতে, যাতে করে এ সমস্যার কার্যকর সমাধান হয়।"