নতুন রাজনৈতিক দলের ছড়াছড়ি: মাঠে নেই, আত্মপ্রকাশেই সীমাবদ্ধ বেশিরভাগ

২০২৪ সালের গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে অন্তত ২০টি দলের জন্ম হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হতে পারে, রাজনীতিতে নতুন বিপ্লব এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ দল শুধু আত্মপ্রকাশেই সীমাবদ্ধ, মাঠে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি আবেদন জমার আহ্বানের প্রায় এক মাস পার হলেও ৭ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন আত্মপ্রকাশ করা কোনো দলই নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেনি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর জন্ম নেওয়া নতুন দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে প্রথম সারিতে থাকা শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এছাড়াও যেসব দল আত্মপ্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে আছে সমতা পার্টি, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), দেশ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, মুক্তির ডাক ৭১, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, আমজনতার দল ও গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি।
দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে এনসিপি। তবে সেটা আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি।
অন্য দলগুলোর বেশিরভাগেরই স্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। কিছু দল শুধু আত্মপ্রকাশেই সীমাবদ্ধ। অনেকেই এখনও কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি। আবার কয়েকটি দল বিভিন্ন থানা ও জেলায় আংশিক কিছু কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কয়েকটি দল অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে বলে তাদের পক্ষে মাঠে কোনো কার্যক্রম নেওয়ারও সুযোগ নেই।
বেশ কয়েকটি দল আত্মপ্রকাশের দিন দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনে ব্যাপক কাজ করার ঘোষণা দিলেও সেগুলো ঘোষণাতেই হারিয়ে গেছে।
এদিকে দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমশন গত মার্চে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করলেও ৭ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন কোনো দলই নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেননি। এদিন পর্যন্ত মাত্র একটি দল—বাংলাদেশ কনজারভেটিভ পার্টি—নিবন্ধন আবেদন জমা দেয়। এই দলটি ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগেও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু সব শর্ত পুরণ করতে না পারায় সেবার নিবন্ধন পায়নি।
বাংলাদেশ কনজারভেটিভ পার্টির মহাসচিব খায়েছ আহমেদ ভুঁইয়া টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দলের কার্যক্রম চলছে বহু বছর যাবত। ২০২৪ সালেও আমরা নিবন্ধন আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তথ্যে একটু গরমিল হওয়ায় তখন আমাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। এখন সেগুলো ঠিক করে আবার আবেদন দেওয়া হলো।'
একটি রাজনৈতিক দলের একটা আদর্শ থাকে, একটা আইডোলজি থাকে। কিন্তু এসব দলের তো কোন আইডলজি নেই। ফলে রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটি থাকেনা। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ দল আসে শুধুমাত্র আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে। এই দলগুলোর একটা বড় অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণও করে না। করলেও কোন প্রার্থী জেতার রেকর্ড একেবারেই কম, এমনকি প্রার্থীদের জামানতও হারাতে হয়। তিনি আরও বলেন, আবার যেহেতু এখন একটা দল করতে খুব একটা খরচ করতে হয় না, তাই একের পর এক দল চলে আসে। আবার যেহেতু আমাদের গণতান্ত্রিক পন্থায় এগুলোকে বাধা দেয়ার কোন ইখতিয়ার নাই, তাই তারা তাদের মত আসছে।
এদিকে এ ধরনের দলের সমালোচনা করে প্রখ্যাত আইনজীবী শাহদীন মালিক টিবিএসকে বলেন, 'একটি রাজনৈতিক দলের একটা আদর্শ থাকে, একটা আইডিওলজি থাকে। কিন্তু এসব দলের তো কোনো আইডিওলজি নেই। ফলে রাজনৈতিক কার্যক্রম থাকে না। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ দল আসে শুধুমাত্র আর্থিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে।'
তিনি আর বলেন, 'এই দলগুলোর একটা বড় অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণও করে না। করলেও কোনো প্রার্থী জেতার রেকর্ড একেবারেই কম—এমনকি প্রার্থীদের জামানতও হারাতে হয়।
'আবার যেহেতু এখন একটা দল করতে খুব একটা খরচ করতে হয় না, তাই একের পর এক দল চলে আসে। আবার যেহেতু আমাদের গণতান্ত্রিক পন্থায় এগুলোকে বাধা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই, তাই তারা তাদের মতো আসছে।'
গণবিজ্ঞপ্তির আগেই নিবন্ধনের জন্য ১৩টি দল আবেদন করেছিল
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নিবন্ধন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিল ১৩টি রাজনৈতিক দল। এগুলো হচ্ছে: ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ বাংলাদেশ), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি), সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন আন্দোলন, বাংলাদেশ বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক দল, ন্যাশনাল কংগ্রেস বাংলাদেশ (এনসিবি), বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি-জাতীয় পার্টি, তৃণমূল জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি, সর্বজন বিপ্লবী দল ও মৌলিক বাংলা।
তবে নির্বাচন কমিশন দল নিবন্ধনের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করে জানা যায়, ২০২৪ সালে কমিশনে আবেদন করে যেসব দল নিবন্ধন পায়নি, সেসব দলের অনেকে তাদের আবেদন পুনর্মূল্যায়নের অনুরোধ জানিয়ে আপিল করেছে। তবে আইনে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই; তাই তাদের আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে। দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ ২০ এপ্রিল।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পেতে নতুন ৯৩টি দল আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের মধ্যেই কিংস পার্টি হিসেবে পরিচয় পাওয়া দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বিতর্কিত বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিকে নিবন্ধন দেয় তৎকলীন নির্বাচন কমিশন।
তার আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে শর্ত পূরণ না করার কারণ দেখিয়ে আবেদন করা ৭৬টি দলের কোনোটিকেই নিবন্ধন দেয়নি নির্বাচন কমিশন। পরে ২০১৯ সালে ববি হাজ্জাজের দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট আদালতের আদেশে নিবন্ধন পায়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নিবন্ধন পেয়েছে বেশ কয়েকটি দল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আদালতের নির্দেশে এবি পার্টি নিবন্ধন পায়। এ ছাড়া নুরুল হক নুরের গণ অধিকার পরিষদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। এছাড়াও আদালতের আদেশে নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)।
নির্বাচন কমিশনে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রথা চালু হয়। এ পর্যন্ত ৫৩টি দল ইসির নিবন্ধন পেলেও পরবর্তীতে শর্ত পূরণ, শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে পাঁচটি দলের—জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপা—নিবন্ধন বাতিল করা হয়। এ অবস্থায় এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪৯।