‘হাতবোমা বানানো এখন ডাল-ভাত’: চার দশক ধরে বিলাসপুরে বংশীয় দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছে ভয়াবহতায়

১৯৮৪ সাল থেকেই জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নে দুটি বংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী সংঘাতে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে দুটি পক্ষে বিস্তার লাভ করে বিলাসপুরের বংশীয় দ্বন্দ্ব।
ওই ইউনিয়নের ২১টি গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তাদের সমর্থকরা। সামান্য বিষয় নিয়েও সংঘাত-সংঘর্ষে, সময় অসময়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন বিলাসপুরের মানুষ।
অভিযোগ রয়েছে, এ দ্বন্দ্বের সূচনা বিলাসপুরের আব্দুল লতিফ ওরফে মেছার মাস্টার এবং আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে। তাদের মধ্যকার সেই দ্বন্দ্ব আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন বিলাসপুরবাসী।
আনোয়ার আর মেছার মাস্টারের সেই দায়িত্ব যেন কাঁধে নেন কুদ্দুস বেপারী ও জলিল মাদবর। ২০০৯ সালের পর নেতৃত্বে চলে আসেন তারা দুজন।
একসময়ের স্থানীয় ছেমদা, রামদা, ট্যাটা, ঢাল-সড়কির সেই সংঘর্ষ এখন রূপ নিয়েছে হাতবোমায়। কুদ্দুস আসার পর থেকে প্রায় এক যুগ ধরে এ অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রতিনিয়তই এ দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বোমাআতঙ্কে ভুগছেন।
সর্বশেষ ৫ এপ্রিল কুদ্দুস ও জলিল গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে নারীসহ অন্তত ১৬ জন আহত হন। ওই সংঘর্ষে হাতবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: শরীয়তপুরে আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ: শতাধিক হাতবোমা বিস্ফোরণ, আহত ১৬
কুদ্দুস ও জলিল দুজনেই আওয়ামী লীগের নেতা। কুদ্দুস বেপারী জাজিরা উপজেলার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বর্তমান বিলাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। অন্যদিকে, জলিল মাদবর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ও পরাজিত চেয়ারম্যান-প্রার্থী।
এ দুজনের বিরুদ্ধেই জাজিরা থানায় রয়েছে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলাসহ অন্তত ৭০টি মামলা। এরই একটি মামলায় কারাবন্দি জলিল মাদবর। সদ্য একটি মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন কুদ্দুস বেপারী।
কুদ্দুস বেপারী ছিলেন সাবেক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হকের অনুসারী। অপরপক্ষে, মোবারক আলী শিকদারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন জলিল মাদবর।
এ দুই নেতার সমর্থনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে কুদ্দুস ও জলিল। এদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে সন্ত্রাসী বাহিনী। পদ্মা নদীর জেগে ওঠা চর দখল, বালু বিক্রি নিয়ন্ত্রণ, নৌপথের দখল, ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলে আসছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুদ্দুস বেপারীর এক সমর্থক জানান, ক্ষমতা প্রদর্শনে উভয় বাহিনী শতশত হাতবোমা তৈরি করে থাকে। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা থেকে নদীপথে ককটেল বানানোর বিস্ফোরক দ্রব্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়।
তিনি আরও জানান, 'বোমা বানাতে আমরা নিজেরাই পারদর্শী। তাই এলাকায় বসে নিজেরাই হাতবোমা তৈরি করে মজুত করে রাখি। কোনো ধরনের সংঘর্ষ সৃষ্টি হলে উভয় পক্ষের সমর্থকরা বালতিতে নিয়ে বোমা ফাটিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে এবং নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখেন।'
জলিল মাদবরের এক সমর্থকও নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, 'বোমা বানানো এখন আমাদের কাছে ডাল-ভাতের মতো। বহু বছর ধরে বোমা বানানোর কাজ করছি। এলাকায় সংঘর্ষে ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় আমরা এগুলো সাপ্লাইও দিয়ে থাকি।'
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বোমার সংঘর্ষের কারণে এ পর্যন্ত ৫ থেকে ৭ জন নিহত হয়েছেন। বোমার আঘাতে হাত, পা, চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
এ ইউনিয়নের অনেকের হাতের কব্জি নেই, কারও কানের লতি নেই, কেউবা অন্ধ।
মুলাই বেপারীকান্দি এলাকার আব্দুল সাত্তার বেপারী বলেন, 'জমিজমা বা টাকা-পয়সা নিয়ে মারামারি হয় না। কে মাতুব্বরি করবে, এটা নিয়েই বিরোধ। আর দুই পক্ষই বোমা ফাটিয়ে ক্ষমতা দেখায়। আমরা এলাকাবাসী আতঙ্কে থাকি। বাড়িতে বানায় কিন্তু প্রশাসন কি এগুলো দেখে না? আমরা এ বোমা আতঙ্ক থেকে বাঁচতে চাই।'
বিলাসপুর গ্রামের রোজিনা বেগম বলেন, 'দুই পক্ষের মধ্যে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। আমরা বাড়িতে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকি। বছর পর বছর এমন আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি। ছেলেপেলে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি — বড় হলে এরা আবার বোমা বানানোর কাজে লেগে যায় কি না।'
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল আকন্দ বলেন, 'যুগ যুগ ধরে চলে আসা বিরোধ নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্যোগ নিয়েছে। উভয় পক্ষকে একত্র করে মীমাংসাও করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'কিছুদিন ভালো থাকার পর তারা আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এলাকাটি প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় এমন কাজ করা তাদের জন্য সহজ হয়েছে।'
তার ভাষ্য, 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে বোমা তৈরির রসদ এবং কারা এর সাথে সম্পৃক্ত তা বের করে ইতোমধ্যেই ওই দুই পক্ষের কয়েক শত সমর্থকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'এমনকি এদের মূল হোতা কুদ্দুস বেপারী ও জলিল মাদবরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়, কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজ করেন।'
'এ ধরনের সহিংসতা নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে,' জানান ওসি দুলাল আকন্দ।