নতুন করে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ, সেইসঙ্গে সুযোগ দেখছে ইসলামী কট্টরপন্থীরাও

নারীদের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের অবস্থানের জানান দিতে শুরু করে কট্টরপন্থীরা।
বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা বিভিন্ন শহরে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে শুরু করেছে। এক শহরে তারা ঘোষণা দিয়েছে, তরুণীরা আর ফুটবল খেলতে পারবে না। আরেক শহরে তারা পুলিশকে বাধ্য করেছে এমন এক ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে, যে জনসমক্ষে মাথা না ঢাকার কারণে এক নারীকে হয়রানি করেছিল। মুক্তি পাওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
এরপর আরও উগ্র ও নির্লজ্জ দাবি উঠতে থাকে। রাজধানী ঢাকায় এক সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা সরকারকে হুঁশিয়ার করে জানায়, ইসলাম অবমাননার অভিযোগে যদি সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে, তবে তারা নিজেরাই বিচার করবে। এর কয়েকদিন পর একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী ইসলামী খেলাফতের দাবিতে বিশাল মিছিল বের করে।
বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশের সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছে, তখন দীর্ঘদিন ধরে দেশটির সেক্যুলার চেহারার নিচে চাপা পড়ে থাকা ইসলামী কট্টরপন্থী প্রবণতা প্রকাশ্যে চলে আসছে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ইসলামপন্থী দলের নেতারা—যাদের মধ্যে কয়েকটি দল আগে নিষিদ্ধ ছিল—পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশকে আরও মৌলবাদী পথে নিয়ে যেতে চান। যদিও এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব বেশি আলোচিত হয়নি।
ইসলামপন্থী নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে এমন একটি 'ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠা হোক, যা ইসলাম অবমাননাকারীদের শাস্তি দেবে এবং 'শালীনতা' বজায় রাখবে—এটি এমন একটি অস্পষ্ট ধারণা, যা অনেক দেশে কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধ ও ধর্মীয় শাসনের ভিত্তি তৈরি করেছে।
নতুন সংবিধান প্রণয়নে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা স্বীকার করেছেন, এতে বাংলাদেশের মূল চরিত্র হিসেবে সেক্যুলারিজম থাকবে না। বরং বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দিয়ে দেশকে আরও ধর্মীয় নীতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা হবে।
এই মৌলবাদী উত্থান বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে, যারা বাংলাদেশের দমনমূলক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
তারা আশা করেছিলেন, তার [হাসিনা] একদলীয় শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে বৈচিত্র্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এখন তারা এমন এক ধর্মীয় উত্থানের মুখোমুখি, যা শুধু নারীদেরই নয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও—বিশেষ করে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলোর অনুসারীদের—আরও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে।
'আমরা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলাম। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের ভাইদের রক্ষা করেছি,' বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক, ২৯ বছর বয়সি শেখ তাসনিম আফরোজ এমি। 'কিন্তু পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে পুরো পরিস্থিতি বদলে গেছে।'
সমালোচকরা বলছেন, ৮৪ বছর বয়সি নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কট্টরপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর অবস্থান নেয়নি। তাদের অভিযোগ, মি. ইউনূস নরমপন্থী; তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারের জটিলতায় আটকে গেছেন এবং সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে কট্টরপন্থীরা যখন ক্রমশ জনসমর্থন ও রাজনৈতিক জায়গা দখল করছে, তখন তিনি স্পষ্ট কোনো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে তার সহকারীরা বিষয়টিকে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, বছরের পর বছর কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর তারা বাকস্বাধীনতা ও প্রতিবাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে চায়, যদিও এর ফলে কট্টরপন্থী শক্তির উত্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
হাসিনার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ও মনোবলহীন থাকার পর পুলিশ বাহিনী এখন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছে না। কিছু পুলিশিং দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করা হলেও, তারাও ক্রমশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের চাপে পড়ছে। আন্দোলনের নেতারা চাইছেন, অতীতের দমনপীড়নের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।
বাংলাদেশে যা হতে শুরু করেছে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া মৌলবাদের ঢেউয়ের প্রতিফলন।
আফগানিস্তান ইতোমধ্যে এক কট্টরপন্থী ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে নারীদের মৌলিক স্বাধীনতা প্রায় বিলুপ্ত। পাকিস্তানে ইসলামপন্থী উগ্রপন্থীরা বছরের পর বছর সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের আদর্শ চাপিয়ে দিচ্ছে। ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসনের ফলে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। মিয়ানমারে বৌদ্ধ কট্টরপন্থীদের প্রভাবে জাতিগত নিধন সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক সময়ের উপদেষ্টা এবং বর্তমানে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা নাহিদ ইসলাম স্বীকার করেছেন, দেশটি কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে—'এমন আশঙ্কা আছে।'
তবে তিনি আশাবাদী যে, সংবিধানে পরিবর্তন এলেও গণতন্ত্র, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ধর্মীয় কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে দেশের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধের মানসিকতা টিকে থাকবে। তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি না বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা এসব মৌলিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।'
কেউ কেউ বাংলাদেশের গভীর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের দিকে ইঙ্গিত করে আশার আলো দেখছেন। অন্যরা দেশের অর্থনৈতিক শক্তিকে স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে দেখছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তির ৩৭ শতাংশ নারী, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ হার। ফলে নারীদের ঘরে ফেরানোর যে কোনো উদ্যোগ সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে পারে।
১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা একদিকে কট্টরপন্থীদের কঠোর হাতে দমন করেছেন, অন্যদিকে তাদের তুষ্ট করার নীতিও অনুসরণ করেছেন। তার শাসনামলে পুলিশ কঠোরভাবে ইসলামপন্থীদের দমন করলেও তিনি রক্ষণশীল সমর্থকদের আকৃষ্ট করতে মাদ্রাসা স্থাপনের অনুমোদন দেন এবং শত শত মসজিদ নির্মাণে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন।
হাসিনার বিদায়ের পর ছোট উগ্রপন্থী দলগুলো, যারা বিদ্যমান ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে দিতে চায়, এবং মূলধারার ইসলামপন্থী দলগুলো, যারা গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করতে চায়—তারা এক রক্ষণশীল বাংলাদেশের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক বিনিয়োগ থাকা দলটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পথে হাঁটছে। বছরের শেষের দিকে প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনে তাদের বিজয়ের সম্ভাবনা কম হলেও, তারা মূলধারার ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর প্রতি জনসমর্থনের ঘাটতিকে কাজে লাগাতে চাইছে।
জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, দলটি একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণে তুরস্ককে তাদের আদর্শিক মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে।
'ইসলাম আচরণ ও নীতির দিক থেকে পুরুষ ও নারীদের জন্য সমান নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে,' বলেন মি. পরওয়ার। 'এই নির্দেশনার আওতায় নারীরা যে কোনো পেশায় যুক্ত হতে পারেন—খেলাধুলা, সংগীত, থিয়েটার, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী কিংবা আমলাতন্ত্র।'
তবে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু ধর্মীয় নেতা এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
উত্তরবঙ্গের কৃষিনির্ভর শহর তারাগঞ্জে গত মাসে দুই তরুণী দলের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মেয়েদের অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের জন্য বিনোদনের সুযোগ তৈরি করা।
কিন্তু প্রস্তুতি শুরুর পরপরই শহরের মসজিদের ইমাম আশরাফ আলী ঘোষণা করেন, নারী ও মেয়েদের ফুটবল খেলা উচিত নয়।
সাধারণত ক্রীড়া আয়োজকরা শহরের বিভিন্ন স্থানে রিকশায় লাগানো লাউডস্পিকারের মাধ্যমে খেলার প্রচার করেন। তবে মি. আলী তার নিজস্ব লাউডস্পিকার ব্যবহার করে লোকজনকে খেলা বর্জনের আহ্বান জানান।
৬ ফেব্রুয়ারি যখন খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুম হিসেবে ব্যবহৃত শ্রেণিকক্ষে জার্সি পরছিলেন, তখন স্থানীয় কর্মকর্তারা খেলা নিয়ে বৈঠকে বসেন। মি. আলী সেখানে ঘোষণা দেন, 'ম্যাচটি হতে দেওয়ার চেয়ে আমি শহীদ হওয়া পছন্দ করব,' বলেন আয়োজকদের একজন, সিরাজুল ইসলাম।
শেষ পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন চাপের মুখে খেলা বাতিল ঘোষণা করে এবং পুরো এলাকায় কারফিউ জারি করে।
ওই ম্যাচে খেলতে বাসে চড়ে চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সি তসলিমা আক্তার। তিনি 'অসংখ্য গাড়ি, সেনাবাহিনী ও পুলিশ' দেখেছেন বলে জানান। তারা খেলোয়াড়দের জানিয়ে দেন—খেলা বন্ধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ফুটবল ক্যারিয়ারের এক দশকে এই প্রথমবারের মতো তিনি এমন বিরোধিতার মুখোমুখি হলেন।
'আমি এখন কিছুটা ভীত যে সামনে কী হতে পারে,' বলেন তিনি।
কয়েক সপ্তাহ পর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আয়োজকরা নারীদের একটি ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করতে সক্ষম হন। তবে সতর্কতা হিসেবে খেলোয়াড়দের হাফপ্যান্টের নিচে মোজা পরতে বলা হয়।
ধর্মীয় প্রচারকদের ধারাবাহিক বাধার পর আয়োজকরা বলছেন, তারা নিশ্চিত নন যে ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে কি না।
এক সাক্ষাৎকারে মসজিদের ইমাম মি. আলী গর্বের সঙ্গে বলেন, তিনি 'একটি সাধারণ বিষয়কে বিতর্কিত করে তুলেছেন।' তার দাবি, তারাগঞ্জের মতো গ্রামীণ এলাকায় নারীদের ফুটবল খেলা 'অশ্লীলতা' বাড়িয়ে দেয়।
নারীদের খেলাধুলা ছিল তার সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু। এর আগে তিনি বছরের পর বছর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু এই মুসলিম গোষ্ঠীর ৫০০ সদস্যকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করারও চেষ্টা চালানো হয়।
হাসিনা সরকারের পতনের রাতে আহমদিয়া উপাসনালয়ে একদল জনতা হামলা চালায়। এটি ছিল সংখ্যালঘু ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে বিশেষত হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর চালানো দেশব্যাপী সহিংসতার অংশ।
এখনও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায়। তাদের উপাসনালয়ে উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদেরকে ভাঙা সাইনবোর্ড মেরামত করতে বা লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আজান প্রচার করতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।
মি. আলী সহিংসতার দায় এড়িয়ে গেলেন। তবে তার মতো প্রচারকরা এখনো ধর্মীয় বয়ানে আহমদিয়াদের 'ধর্মদ্রোহী' আখ্যা দিয়ে তাদের বহিষ্কারের আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন।
'জনগণ শ্রদ্ধাশীল,' বলেন স্থানীয় আহমদিয়া শাখার সভাপতি এ.কে.এম. শফিকুল ইসলাম। 'কিন্তু এই ধর্মীয় নেতারা আমাদের বিরুদ্ধে।'