ক্রেতাদের ‘ওপেন কস্টিং’ পদ্ধতির কারণে লাভ কমছে পোশাক রপ্তানিকারকদের

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা ক্রমশ লাভ কমে যাওয়ার সংকটে পড়ছেন। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো 'ওপেন কস্টিং' পদ্ধতির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিচ্ছে, যার ফলে কারখানাগুলোর জন্য লাভজনক থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। গত এক দশকে এই পদ্ধতির আওতায় মূল্য নির্ধারণ মোট রপ্তানির ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে, ফলে অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
ওপেন কস্টিং কী?
ওপেন কস্টিং পদ্ধতিতে ক্রেতারা কাঁচামাল, শ্রম, ওভারহেড ও লাভের মার্জিনসহ উৎপাদন ব্যয়ের পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। এতে ক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়লেও কারখানা মালিকরা বলছেন, উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে। যেমন, সরবরাহ শৃঙ্খল অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাহত হওয়া, কাঁচামালের দেরিতে সরবরাহ, গোপন লেনদেনে বাধ্য হওয়া কিংবা শ্রমিক অসন্তোষজনিত কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া—এসব খরচ ওপেন কস্টিংয়ের আওতায় আসে না, অথচ এগুলো উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ
অনন্ত গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, ওপেন কস্টিংয়ের কারণে লাভের মার্জিন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। 'সামান্য পরিবর্তনও আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ ক্রেতারা বেশিরভাগ কাঁচামালের উৎস [কারখানা] নির্ধারণ করে দেন, ফলে আমরা বিকল্প ব্যবহারের সুযোগ পাই না।'
তিনি জানান, ২০২৩ সালে গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষের সময় তার কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আশুলিয়ায় আরও কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই ক্ষতি আরও বেড়েছে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, তার প্রতিষ্ঠান বছরে ৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যার ৭০ শতাংশের মূল্য নির্ধারিত হয় ওপেন কস্টিংয়ের মাধ্যমে। তিনি বলেন, 'এটি অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি। এই পদ্ধতি স্থিতিশীল উৎপাদন পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল, অথচ বাংলাদেশে তা প্রায়শই অনিশ্চিত।'
কম প্রফিট মার্জিন ও প্রতিযোগিতার চাপ
রপ্তানিকারকরা বলছেন, স্থানীয় কারখানাগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে তারা ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষির সুযোগ হারাচ্ছেন। বর্তমানে উৎপাদনব্যয়ের ভিত্তিতে তাদের লাভের মার্জিন মাত্র ১ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তাদের আরও অভিযোগ, ওপেন কস্টিংয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতারা পোশাক শিল্পকে সরকার প্রদত্ত কর ছাড় ও নগদ প্রণোদনার সুবিধার কথাও বিবেচনা করেন। ফলে এই সুবিধাগুলো রপ্তানিকারকদের পরিবর্তে ক্রেতাদের কাছে চলে যাচ্ছে।
মূল্য নির্ধারণের আরেকটি পদ্ধতি 'ফ্রেইট অন বোর্ড' (এফওবি), যেখানে খরচের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রভাবক অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে ওপেন কস্টিংয়ের অধীনে কাঁচামাল ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ের ওপর অতিরিক্ত লাভের সুযোগ নেই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ওপেন কস্টিং ব্যবহৃত হলেও উদ্যোক্তারা মনে করেন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় এটি তুলনামূলক ভালোভাবে কার্যকর হয়, কারণ এসব দেশে প্রফিট মার্জিন বেশি এবং উৎপাদনে ব্যাঘাত কম।
শোভন ইসলাম বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় ৬০ শতাংশ উপকরণ ক্রেতারা মনোনীত সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে বাধ্য করেন। বাকি খরচও তাদের জানাতে হয়। এর ওপর আমরা সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ প্রফিট মার্জিন রাখতে পারি।'
বড় অর্ডারে ওপেন কস্টিং
উদ্যোক্তারা জানান, সাধারণত বড় অর্ডারের ক্ষেত্রে ওপেন কস্টিং পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পোশাক সংগ্রহকারী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্ডিটেক্স, এইচঅ্যান্ডএম, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, প্রাইমার্ক, সিএন্ডএ, ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ইনকর্পোরেটেড ও ইউনিক্লো।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে হোম টেক্সটাইলও অন্তর্ভুক্ত। এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশের বৃহত্তম একক ক্রেতা, যারা প্রতিবছর প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সংগ্রহ করে।
শোভন ইসলাম বলেন, 'সাধারণত এক লাখের বেশি পণ্যের অর্ডারের মূল্য নির্ধারিত হয় ওপেন কস্টিং পদ্ধতিতে। বড় ক্রেতারা বড় পরিসরের অর্ডার দেওয়ায় তারা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেন।'
তিনি আরও জানান, দেশে অন্তত ১২০টি বড় কারখানা ওপেন কস্টিং পদ্ধতিতে অর্ডার সরবরাহ করে।
শোভন ইসলাম বলেন, ওপেন কস্টিং মূলত উচ্চমূল্যের বা বিশেষায়িত পোশাকের জন্য নয়; এটি সাধারণত ডেনিম, টি-শার্ট ও পোলো শার্টের মতো মৌলিক পোশাকের মূল্য নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। 'বাংলাদেশ মূলত মৌলিক পোশাক উৎপাদন করে, তাই মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।'
ক্রেতারা কি আরও দাম কমিয়ে দেন?
কয়েকজন রপ্তানিকারক জানান, অনেক সময় ক্রেতারা ওপেন কস্টিং অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতেও চান না।
ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলি শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, 'ধরুন, ওপেন কস্টিং পদ্ধতিতে একটি টি-শার্টের দাম ১ ডলার নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু ক্রেতারা সরাসরি এই দামে অর্ডার না দিয়ে আরও চারজন সরবরাহকারীর কাছে যান এবং জানতে চান, কেউ কি টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কম দামে অর্ডার নিতে রাজি আছেন কি না।'
তিনি বলেন, 'কেউ ০.৯৮ ডলারে, কেউ ০.৯৬ ডলারে অর্ডার নিতে রাজি হন। ফলে শেষ পর্যন্ত সর্বনিম্ন দরদাতা অর্ডারটি পান।'
এই মূল্য প্রতিযোগিতা রপ্তানিকারকদের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করছে। কেন তারা এত কম দামে অর্ডার নিতে বাধ্য হন, সে বিষয়ে এহসান বলেন, 'কিছু কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকে। কাজ কমে গেলে মজুরি, ওভারহেড খরচ এবং অন্যান্য ব্যয়ের চাপ বেড়ে যায়। এ কারণে ক্ষতি কমাতে কারখানাগুলো অনেক সময় ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে বা ক্ষতি মেনে নিয়েও অর্ডার নিতে বাধ্য হয়।'
নীতিগত পোশাক উৎপাদন নিয়ে কাজ করা দ্য ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন বলেছে, ব্র্যান্ডগুলোর উচিত ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব নেওয়া এবং ওপেন কস্টিং পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি হয় এবং বাংলাদেশি পোশাকের দাম কম থাকার অভিযোগ নিয়ে টিবিএস ইমেইলের মাধ্যমে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ ইনকর্পোরেটেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
এইচঅ্যান্ডএম ইমেলের জবাব দিলেও ব্যবসায়িক গোপনীয়তার কারণে কোনো তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।
এইচঅ্যান্ডএম গ্রুপ জানায়, 'আমাদের সকল উৎপাদন বাজারে ওপেন কস্টিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশ আমাদের অন্যতম বড় উৎপাদন বাজার এবং আমরা দায়িত্বশীল ক্রয় প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যাতে সরবরাহকারীদের সঙ্গে ন্যায্য ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব বজায় থাকে।'
রপ্তানিকারকরা কি দাম বাড়াতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন?
কারখানার মালিকরা বলছেন, স্থানীয় রপ্তানিকারকদের মধ্যে 'অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা' ক্রেতাদের সহজেই দাম কমানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। তারা মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ এবং সরবরাহকারীদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা জরুরি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আরএমজি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'যদি সব কারখানা একসঙ্গে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ক্রেতারা বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না।'
তিনি আরও বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়লেও বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের অন্যতম সস্তা পোশাক সরবরাহকারী দেশ। তবে রপ্তানিকারকরা এখনো লোকসানের মধ্যে অর্ডার গ্রহণ করছেন।
ইউকে ট্রেড ইনফো-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়কালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত পোশাকের গড় মূল্য চীনের তুলনায় ২১.৩৯ শতাংশ, তুরস্কের তুলনায় ৩২ শতাংশ এবং ভারতের তুলনায় ২৬.৭৫ শতাংশ কম ছিল।