লবণাক্ততা কমায় চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উৎপাদন বেড়েছে, অনুমোদনের অপেক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্প

হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে পানির উৎপাদন সাময়িকভাবে কমে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
তবে বৃষ্টিপাত কম থাকলে ঈদের আগে লবণাক্ততা ফের বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
চলতি মাসের শুরুতে হালদা নদীর লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। লবণাক্ততার হার কমে এখন ১ হাজার ৩০০ মিলিগ্রামের নিচে নেমেছে। ফলে পানির উৎপাদন ৪২-৪৩ কোটি লিটার থেকে বেড়ে ৪৭ কোটি লিটারে উন্নীত হয়েছে।
এদিকে পানির ক্ষতি কমাতে ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার প্রকল্প নিতে যাচ্ছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রকল্পটির আওতায় দুই বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে ৫৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন, পুরনো পাইপলাইন প্রতিষ্ঠান ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, সংস্থাটির পানির উৎস হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদীর মধ্যে হালদায় লবণাক্ততা বেড়েছিল। ফলে দৈনিক ৯ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং ৯ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছিল ৩-৫ কোটি লিটারের মতো।
হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার কারণে দিনে দুইবার জোয়ারের সময় এ দুটি শোধনাগার ৫ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
চলতি মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রতি লিটার পানিতে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গিয়েছিল। তবে লবণাক্ততার হার কমে বর্তমানে ১ হাজার ৩০০ মিলিগ্রামের নিচে নেমেছে।
এছাড়া ভাটার সময় কর্ণফুলী নদীতে পানির স্তর কমেছে। কর্ণফুলী নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল দৈনিক ১৪ কোটি লিটার করে ২৮ কোটি লিটার উৎপাদন সক্ষমতার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার ১ ও ২-এ ভাটার সময় পানির স্তর কমে গেছে।
এ কারণে এ দুই প্রকল্পে পানির উৎপাদন কমেছে দৈনিক ২ থেকে ৩ কোটি লিটার।
সবমিলিয়ে সংস্থাটির চারটি পানি শোধনাগারে মোট ৬ থেকে ৮ কোটি লিটারের মতো পানির উৎপাদন কমেছিল। মোট ৫০ কোটি লিটার সক্ষমতার মধ্যে মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে দৈনিক উৎপাদন ৪২-৪৩ কোটি লিটার পর্যন্ত নেমে এসেছিল। বর্তমানে তা আবার ৪৭ কোটি লিটারে উন্নীত হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পানির উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি। এরমধ্যে গ্রীষ্ম মৌসুমে লবণাক্ততার হার বৃদ্ধি ও পানির স্তর নামলে সংকট আরও বেড়ে যায়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে টানা ৪-৫ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত হলে অনুকূল পরিবেশ পাওয়া যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।'
পানি সরবরাহ উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্প
চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন পাইপলাইন, স্মার্ট মিটার স্থাপনসহ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রায় ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নিতে যাচ্ছে ওয়াসা।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটির অধীনে ৩৭৬ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপন ও ৯০ হাজার স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হবে। পাশপাশি পানি সরবরাহ ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদারে স্থাপন করা হবে ৪৬টি ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ)।
এছাড়া নতুন পানি শোধনাগার নির্মাণ হওয়ার আগপর্যন্ত পানির বর্ধিত চাহিদা মোকাবিলায় ৫৫টি গভীর নলকূপও প্রতিস্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে দৈনিক ৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হবে। প্রকল্পটি বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। পরবর্তী যেকোনো একনেক সভায় ওঠার অপেক্ষায় আছে।
লবণাক্ততা সমস্যার সমাধান
লবণাক্ততা সমস্যা এখন বেশি সময় ধরে থাকছে। এ সমস্যার সমাধানে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন প্রকল্প নিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
গ্রীষ্মে বৃষ্টিপাতের অভাবে পানির উৎস কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ফলে পানি উৎপাদন কমে। আগে সাধারণত বছরের ১৫-২০ দিন লবণাক্ততা নিয়ে বিপাকে পড়তে হতো ওয়াসাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার পাশাপাশি কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি নির্গমনের প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ততা প্রায় দুই মাস স্থায়ী হয়।
২০২২ সালের আগস্টে ফ্রান্সভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা সুয়েজ একটি ধারণাপত্র দিয়েছে। এতে বিকল্প ইনটেক স্টেশন নির্মাণ, প্রি-সেটেলমেন্ট রিজার্ভার, নতুন শোধনাগার নির্মাণকে প্রাধান্য দিয়ে এই প্রকল্পের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি অর্থায়নে আগ্রহী ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) চূড়ান্ত হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক পাঠাবে অর্থায়নকারী সংস্থাটি।
ভবিষ্যৎ চাহিদার জন্য অবকাঠামো পরিকল্পনা
পানির ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে তিন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।
প্রথম অংশে ভান্ডালজুড়িতে দৈনিক ৮৪ কোটি লিটার অপরিশোধিত পানি সংগ্রহের জন্য ইনটেক স্টেশন ও প্রি-সেটেলমেন্ট রিজার্ভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া দৈনিক ৬৩ কোটি লিটার সক্ষমতার পানির পাম্প স্টেশন স্থাপন, ভান্ডালজুড়ি থেকে মোহরা ও মদুনাঘাট পানি শোধনাগার পর্যন্ত দৈনিক ৪২ কোটি লিটার সক্ষমতার রিভার ক্রসিং পাইপলাইন (কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে) স্থাপন, মোহরায় দৈনিক ২০ কোটি লিটার সক্ষমতার নতুন পানি শোধনাগার নির্মাণ, সেবার পরিধি বাড়াতে মোহরা থেকে বায়েজিদ লিংক রোড পর্যন্ত পাইপলাইন ও রিজার্ভার এবং সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
মোহরা পানি শোধনাগারে ব্যবহারোপযোগী জমি থাকায় ধারণাপত্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশে আরও দুটি নতুন শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, 'পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার কমানো, ওয়াসার গ্রাহকদের কাছে পানি পৌঁছানেসহ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। এছাড়া ৫৫টি গভীর নলকূপ দিয়ে চাহিদা পূরণ করা হবে। আর ইনটেক স্থানান্তর প্রকল্পটির অর্থায়নের জন্য ইডিসিএফ সম্মত হয়েছে। তারা সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক টিম পাঠাবে।'