অর্থ পাচারের তদন্ত করতে গিয়ে যেভাবে ৪৫ কোটি টাকার ক্রিপ্টোকারেন্সি জব্দ হলো

দুবাইভিত্তিক ট্রেডিং অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ-এর (এমটিএফই) মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচারের চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে ৩.৭ মিলিয়ন ডলার (৪৫ কোটি টাকা) ক্রিপ্টোকারেন্সি জব্দ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) উপ-পরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান বলেন, সিআইডির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে স্টেবলকয়েন নামে পরিচিত ভার্চুয়াল এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম ওকেএক্স ইউএসডিটি এই ক্রিপ্টোকারেন্সি জব্দ করেছে।
জব্দ হওয়া এই ভার্চুয়াল মুদ্রা এমটিএফই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ।
প্রতারণার মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠে এমটিএফইর বিরুদ্ধে। এরপর ভুক্তভোগীদের মামলা ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। সিআইডি বাংলাদেশের আদালতের আইনি অনুমতি নিয়ে ওকেএক্সে আবেদন করে। এরপর সম্প্রতি ওকেএক্সে থাকা এমটিএফইর ভার্চুয়াল মুদ্রা জব্দ করা হয় বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, দেশ থেকে পাচার হওয়া এই অর্থ জব্দের প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সহযোগিতা করেছে। আইনি মীমাংসা হলেই এই অর্থ দেশে ফেরত আসতে পারে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, অ্যাকাউন্ট জব্দ করা মানেই টাকাগুলো নিশ্চিতভাবে ফেরত আনা যাবে, এমনটা নয়।
'কেননা ক্রিপ্টোকারেন্সির প্ল্যাটফর্মগুলো অনেকসময় অবৈধ টাকা বা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ পেলে অ্যাকাউন্ট জব্দ করে ঠিকই, কিন্তু শতভাগ তথ্য-প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত তারা টাকা হস্তান্তর করবে না।'
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, যারা এই টাকা পাচার করেছে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা এবং কোনো সুস্পষ্ট আইনের মাধ্যমে লেনদেনগুলো যে অবৈধ হয়েছে, তা প্রমাণ করা।
তাছাড়া এই টাকা সহজে ফেরত পাওয়া যাবে কি না সেটি অনেকাংশে নির্ভর করবে এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার ওপরও। 'কেননা এই ধরনের ক্রিপ্টো ব্যবসায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা তাদের গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকে।'
এমটিএফই প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্টে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা) নিয়ে গায়েব হয় এমটিএফই। এই ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের।
প্ল্যাটফর্মটি মূলত বিনিয়োগকারীদের উচ্চ রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করত। প্ল্যাটফর্মটি প্রলোভন দেখাত, কিছু টাকা বিনিয়োগ করলেই হওয়া যাবে প্রতিষ্ঠানের সিইও। প্রতিদিন মিলবে দ্বিগুণ-তিনগুণ মুনাফা।
এজন্য ট্রেডিং করতে হবে বিদেশি অ্যাপে। সে আশায় এখানে লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেন অগণিত মানুষ। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আল ইসলাম বিদেশে পলাতক রয়েছেন।
এই প্রতারণার ঘটনায় ২০২৩ সালের ২৩ জুলাই রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করা হয়। যৌথ তদন্তের পর এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এখনও এই মামলার কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলো।
রাজশাহীর রাজপাড়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, 'এই মামলাটি তদন্তাধীন।'
এমটিএফই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে বিনিয়োগ করেছিলেন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. মারুফ রহমান মাহিম। তিনি বলেন, 'এমটিএফইর অ্যাম্বাসেডর মুবাশসিরুল ইবাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে পরিচয় ছিল। তার মাধ্যমে এমটিএফইতে আমি ও পরিবারের সদস্যরা প্রায় ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হই।'
এ ঘটনায় মাহিম খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। এরপর মামলাটি সিআইডিতে যায়। তবে এখনও টাকা উদ্ধার ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলে দাবি করেন মাহিম।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তরিকুল ইসলাম বলেন, 'মামলার বাদী যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, তারাও কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তারা গ্রাহক পর্যায় থেকে টাকা নিয়ে চক্রের ওপরের পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিয়েছেন।'