এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পুড়ছে মাতুয়াইলের ভাগাড়, বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টে ভুগছেন স্থানীয়রা

সোমবার সকালে যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম রাস্তা পার হওয়ার সময় চোখে জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। এ সময় বাতাস ছিল ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, যা মাতুয়াইলের দিকে এগোতেই আরও তীব্র হতে থাকে।
পরে তিনি জানতে পারেন, এ দূষণের উৎস মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড়। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বর্জ্য পুড়ছে সেখানে।
"বেশ কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যার পরে যাত্রাবাড়ীতে আমার বাসায় ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এতদিন এর কারণ বুঝতে পারিনি। এখন জানতে পারলাম, এই ধোঁয়া মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিল থেকে আসছে। ধোঁয়ায় চোখ ও মুখ জ্বালাপোড়া করে। মাঝেমধ্যে তো সন্ধ্যার পরে শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে ওঠে," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন সিরাজুল।
কেবল সিরাজুল একা নন। মাতুয়াইল, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, বিবি বাগিচা, দয়াগঞ্জ, গোলাপবাগ, ঢালপুর, সায়েদাবাদ, মানিকনগর এবং আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও এ বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
আর বিষাক্ত ধোঁয়ার উৎস মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের বিশাল অংশে লাগা আগুন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের আয়তন প্রায় ১৮১ একর। এই ল্যান্ডফিলে প্রতিদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকা থেকে প্রায় ৩,৫০০ টন বর্জ্য এনে সংরক্ষণ করা হয়।
সম্প্রতি মাতুয়াইলের এই ময়লার ভাগাড় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ইতোমধ্যে ল্যান্ডফিলের ২-৩টি বিশাল আকৃতির ময়লার স্তূপ অধিকাংশ পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছে এবং সেগুলো থেকে ব্যাপক কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। এছাড়া, বাকি স্তূপগুলোতেও অসংখ্য স্থানে থেমে থেমে আগুন জ্বলছে এবং চারিদিক কালো ধোঁয়ায় আবৃত।
বড় আকারের আগুনের স্থানগুলোতে আগুন নেভানো হলেও ল্যান্ডফিলের আগুন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সব স্থানে উপর দিকে আগুন জ্বলতে দেখা না গেলেও ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হতে দেখা যায়। এমনকি, যে স্থানে নতুন বর্জ্য ফেলা হচ্ছিলো, সেখানেও আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড় থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহকারী মমতাজ বেগম টিবিএসকে বলেন, "প্রতি শীতকালের শেষেই এই ভাগাড়ে আগুন লাগে। কিন্তু এবারে আগুন বেশি জায়গায় ছড়িয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় আগে পুরাতন ভাগাড় এলাকায় আগুন জ্বলে। এরপরে ধীরে ধীরে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যায়।"
"কে বা কারা লাগিয়েছে বলতে পারবো না। সন্ধ্যায় দেখে যাই কোনো আগুন নাই কিন্তু পরের দিন সকালে এসে দেখি আগুন জ্বলছে," বলেন মমতাজ।

ঢাকা দক্ষিণের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, "আমরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু এতবড় জায়গার ভিতরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধতন কর্মকর্তা এবং পরিবেশ উপদেষ্টার সাথে আলোচনা করেছি। দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু একটু সময় লাগবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য আসে, সেগুলো লেবেল করে রাখার জন্য অন্তত ১০টি ভারি স্কেভেটর দরকার, কিন্তু আমাদের আছে মাত্র ২-৩টি। এজন্য আমরা বর্জ্যগুলো ঠিকভাবে স্তূপ করে রাখতে পারি না।"
এছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে ল্যান্ডফিলের মিথেন গ্যাসের কারণে বিচ্ছিন্নভাবে যে আগুন লাগে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করাও খুব কঠিন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "একমাস আগে যখন আগুন লাগে তখন আমরা ফায়ার সার্ভিস দিয়ে নেভাই। এরপরে থেমে থেমে বিভিন্ন স্থানে আবার আগুন জ্বলে। সর্বশেষ শনিবারেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিভিয়ে যান।"
"এতবড় জায়গায় আগুন নেভানো সম্ভব না, এরপরেও এখন অনেকটাই কন্ট্রোলে আছে। বড় আকারে বৃষ্টি হলে আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে। এছাড়া আমাদের তেমন কিছু করার নেই," বলেন তিনি।

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেড়েই চলেছে
এলাকাবাসীর অনেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা কথা জানিয়েছেন, এবং হাসপাতালগুলোতে শ্বাসকষ্ট, ফ্লু ও শ্বাসনালীতে প্রদাহজনিত রোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মাতুয়াইলের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথ (আইসিএমএইচ)-এ রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন এর পরিচালক ডা. মো. মজিবুর রহমান।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমাদের হাসপাতালে আগে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন শ্বাসকষ্টের রোগী ভর্তি হতো, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ১৫ জনের মতো ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন। বর্তমানে ৫২ জন রোগী ভর্তি আছেন, যে সংখ্যা কয়েকদিন আগেও ৪০ জনের নিচে ছিল।"
"বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের রোগীরা এই ধোয়ার ফলে বেশি অসুস্থ হচ্ছেন। গর্ভবতী নারী এবং শিশুরা অতিমাত্রায় ঝুঁকিতে আছে," যোগ করেন তিনি।
ডা. মো. মজিবুর রহমান মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, "বাসার বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং ধোঁয়া দেখা গেলে বাসার দরজা, জানালা বন্ধ রাখতে হবে। যখন ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে, তখন ওইসব এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।"
বিশেষ করে গর্ভবতী, শিশু এবং বৃদ্ধদের এমন ক্ষতিকর ধোঁয়া থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের সায়েদাবাদের বাসিন্দা হনুফা বেগম টিবিএসকে বলেন, "গত এক মাস ধরে প্রায়ই সন্ধ্যার পর থেকে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে এলাকা। আর আমি শ্বাস কষ্টের রোগী হওয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। গত এক সপ্তাহে দুইবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাসার বাইরে না যেতে। কিন্তু বের না হয়ে তো পারা যায় না।"
তিনি আরও বলেন, "শুনেছি, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড় থেকে নাকি এই ধোঁয়া আসছে। আমরা চাই দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হোক। সিটি কর্পোরেশন যেন এর ব্যবস্থা নেয়।"

পরিবেশের ক্ষতি
সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, "মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের এমন ঘটনা প্রতি বছরই ঘটছে। আর এই এলাকার বায়ুমান একিউআই ৩০০ এর উপরে থাকে অধিকাংশ সময়। এবারে যে ম্যাসিভ আকারে বর্জ্য পুড়ছে, তাতে আশপাশের প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার এলাকার বায়ুমানে এর প্রভাব পড়েছে।"
তিনি বলেন, "একইসাথে প্লাস্টিক ও অন্যান্য ক্ষতিকর কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া, কার্বন, কার্বন মনোঅক্সাইটের মতো ক্ষতিকর গ্যাস উদগীর হচ্ছে—যা মানুষের নিঃশ্বাসের সাথে গিয়ে সাময়িক বড় সমস্যার সৃষ্টি না করলেও দীর্ঘ মেয়াদী ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।"
পরিবেশ কর্মী হাসনাত জুবায়ের বলেন, "বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরেই সিটি কর্পোরেশন এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি, কিন্তু এক মাস অতিবাহিত হলেও ধোঁয়া থেকে মুক্তি পাননি এই এলাকার মানুষ। বিশেষ করে, সন্ধ্যার পরে বাসার বাইরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকে না। আমরা এই ল্যান্ডফিলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা হোক এবং এই ভোগান্তি থেকে পাক মানুষ।"
পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার বলেন, "আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক আইন ও রুলস আছে, কিন্তু কোনোটারই তেমন বাস্তবায়ন নেই। যারা আইন প্রয়োগ করবেন এবং যাদের উপর করবেন উভয়েই অধিকাংশ আইন সম্পর্কে জানেন না। ফলে আমাদের কর্তৃপক্ষগুলো এসব ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে।"
"এজন্য দরকার টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। একই সাথে সংস্থাগুলোর রিসোর্স এর ঘাটতি পূরণ করতে হবে।"
"সিটি কর্পোরেশনসহ আমাদের সংস্থাগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বড় পরিসরে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। আর দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে বিষয়টি আমাদের হাইকোর্টের নজরে আনতে হবে," যোগ করেন তিনি।