বক্স কালভার্টে কল্যাণপুরে খালের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, জলাবদ্ধতার ঝুঁকি বাড়ছে

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে আটকে পড়া ও ভরাট খালগুলো পুনরুদ্ধার এবং পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন সব অবৈধ স্থাপনা আপসারণে কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ। ঠিক এই সময়ে দেখা গেছে, কিছু অবকাঠামো প্রকল্প কর্তৃপক্ষের এ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে।
উদাহরণ হিসেবে ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক কল্যাণপুর 'চ' খালের ওপর নির্মিত বক্স কালভার্টের কথা বলা যেতে পারে।
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে খালের ওপর নির্মিত এই বক্স কালভার্টের কারণে খালের প্রস্থ অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। যার ফলে ড্রেনেজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং আশেপাশের পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত বিস্তৃত 'চ' খাল। এর আগে, খালটির এই স্থানে একটি আরও প্রশস্ত কালভার্ট ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খালের প্রবাহ ঠিক রাখতে বক্স কালভার্টের পরিবর্তে একটি সেতু বা ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। এর পরিবর্তে, বক্স কালভার্টটির কারণে একটি 'বটলনেক' বা সরু জায়গা তৈরি হয়েছে। আর এই সরু জায়গায় কাদামাটি, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ বিভিন্ন আবর্জনা জমে খালের মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনকালে খালের ধারে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ দেখা যায়, বেশ কয়েকটি অংশে পানি জমে থাকতেও দেখা গেছে; বিশেষ করে কালভার্টের পাশের এলাকায়। সেখানে কাদার পুরু স্তর এবং আগাছা জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
খালটি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটের পিছন দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা জানান, খালের কারণে এলাকায় মশা এবং পোকামাকড়ের উপদ্রব আরও বেড়েছে। এতে স্থানীয়দের পাশাপাশি ভুগছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরাও।
খালের পাড়ের বাসিন্দা নেসার আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই খাল গত এক বছর ধরে কেউ পরিষ্কার করছে না। মশায় উপদ্রবের কারণে দিনেও এখানে টেকা দায়।"
তিনি বলেন, "গত বর্ষায় এই খালের পানি উপচে আমাদের ঘরে উঠে যায়। পরে আমরা স্থানীয় লোকজন মিলে খালের মুখগুলো পরিষ্কার করে পানি নামতে পথ তৈরি করে দেই।"
পঙ্গু হাসপাতালের পেছনের বস্তিতে বসবাস করা খালের পাড়ের বাসিন্দা জাকিয়া বেগম টিবিএসকে বলেন, "আগে খাল পরিষ্কার করতো, কিন্তু এখন আর পরিষ্কার হয় না। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন গত কয়েকমাস ধরে বাসাবাড়ির ময়লাও নিচ্ছে না, ফলে বস্তিবাসী এখান খালেই সরাসরি ময়লা ফেলে।"
"১ থেকে ২ ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই খালের পানি ঘরে উঠে যায়। খালে ময়লা এসে কালভার্টের মুখ আটকে যায়। বৃষ্টির সময় পানির প্রবাহ অনেক বেশি থাকে, কিন্তু সেই পরিমাণ পানি বক্স কালভার্টের কারণে অপসারণ হতে পারে না," যোগ করেন তিনি।
৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সড়ক প্রকল্পটি শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও চৌরাস্তা থেকে শ্যামলীর শিশুমেলা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১,৪০০ মিটার দীর্ঘ অংশে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
ছয় লেনের এই সড়কে বাস বে, যাত্রীদের জন্য শেড, সাইকেল লেন এবং রাস্তার পাশে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের আওতায় নির্মিত বক্স কালভার্টটি রাস্তা নির্মাণের সুবিধার্থে তৈরি করা হয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টাকা দিয়ে একটি উঁচু সেতু নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারত, তা করা হলে খাল দিয়ে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতো না।
ঢাকা উত্তরের ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুরাতন) ও সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, "এই প্রকল্পটির পরিকল্পনা হয় ২০১৬ সালে এবং আমরা ২০২১ সালের দিকে এসে ডেনেজ ব্যবস্থা হাতে পাই। এর আগেই ঢাকা ওয়াসা এই খালটির ওপর বক্স কালভার্ট তৈরি করেছিল। ফলে নতুন প্রকল্পে বক্স কালভার্টই রাখা হয়। কিন্তু এই অংশে একটি উঁচু সেতু করা প্রয়োজন ছিল।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের খালগুলো পুনরুদ্ধারের বিষয়ে অন্তবর্তী সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এই খালটিসহ অনেক স্থানেই খালের ওপর বক্স কালভার্ট তৈরি করায় খালগুলোর প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।"
"আমাদের পরিকল্পনা আছে এসব বক্স কালভার্ট ভেঙে উঁচু সেতু নির্মাণের। তবে কাজগুলো ব্যয়বহুল বলে এই সময়ে করা সম্ভব হচ্ছে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিষয়টি," যোগ করেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ খালের বর্জ্য অপসারণে এবং নিয়মিত পরিচর্যার কাজ সম্পন্ন করবে বলে আশ্বস্ত করেন এই কর্মকর্তা।
এদিকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, "এ ধরনের খালের ওপর রাস্তা কিংবা কোনো স্থাপনা করতে হলে যেভাবে পরিকল্পনা হওয়া দরকার, সেটার প্র্যাক্টিস সিটি কর্পোরেশনে নেই।"
"বক্স কালভার্ট তৈরি করার আগেই খালটি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন ছিল। খরচ কিছু বাড়তি গেলেও ওই অংশে কালভার্ট না করে কিছুটা উচ্চতার ব্রিজ নির্মাণ জরুরি ছিল," বলেন তিনি।
এই মুহূর্তে সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, "এখন সিটি কর্পোরেশনের উচিত হবে খালটির বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা। একইসাথে বক্স কালভার্টটি ভেঙে খালের জায়গা ফিরিয়ে দিয়ে উচুঁ ব্রিজের পরিকল্পনা করতে হবে।"
সিটি কর্পোরেশন যদি চায়, দেড় বছরের মধ্যেই খালগুলোর নেটওয়ার্ক সচল করে প্রবাহ ফেরানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।