ব্যাংকখাতে ঝুঁকিগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে: পিআরআই
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে পুনর্গঠিত, পুনঃতফসিলকৃত ও খেলাপি ঋণসহ মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকাতে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
পিআরআই–এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান আজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) রাজধানীর বনানীতে পিআরআই কার্যালয়ে "মান্থলি ম্যাক্রোইকনমিক ইনসাইটস (এমএমআই)" শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, "বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৪ লাখ কোটি টাকা (প্রায় ৩৬ শতাংশ)। কিন্তু মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা এসব সম্পদ বা ঋণ পুনরুদ্ধারের কম সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।"
তিনি বলেন, উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে ঋণ সংকটের ঝুঁকি তৈরি করে এবং বিনিয়োগকে দুর্বল করে। "কমপক্ষে ১৬টি ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এর ফলে বিনিয়োগ কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে এবং উন্নয়ন মন্থর হচ্ছে — যা শেষ পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে ব্যাংকখাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার চারটি বড় পরিণতি দেখা যায় — উচ্চ সুদহার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম প্রবৃদ্ধি এবং কম বিনিয়োগ।
সেপ্টেম্বর–অক্টোবরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান।
ঋণ পরিশোধ করতেও ঋণ করছেন অনেকে
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। "এমনকি যারা এখন ঋণ নিচ্ছেন, তারা মূলত অন্য ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে নিচ্ছেন, যাতে সেই ঋণগুলো অনিয়মিত বা সাবস্ট্যান্ডার্ড না হয়ে যায়।"
পারভেজ অভিযোগ করে বলেন, "অর্থনীতির রক্তক্ষরণ করছে। সরকার কি শুনছে? দুঃখজনকভাবে ব্যবসায়ীদের কথায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই।"
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুন থেকে আগস্টের মধ্যে নেমে গেছে ৭%–এর নিচে — যা ২২ বছরে সর্বনিম্ন।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে এই ঋণ সংকোচন ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিই এখন অর্থনীতির প্রধান ঝুঁকি।
সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকা। তবে পারভেজ মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে, যার জন্য তিনি সরকারি নীতিকেই দায়ী করছেন।
আগে ঋণ পুনঃতফসিল করতে ঋণগ্রহীতাদের ৬ মাস সময় দেওয়া হতো। কিন্তু আগামী মার্চ থেকে এই সময় কমিয়ে ৩ মাস করা হচ্ছে। বিজিএমইএ–এর সাবেক সভাপতি পারভেজ মনে করেন, এই নীতি খেলাপি ঋণ আরও বাড়িয়ে দেবে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য শুধু ব্যবসায়ীরা দায়ী — এমন ধারণার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, "বারবার জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে, ভালো সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু তা হয়নি। ফলে গ্যাস–নির্ভর শিল্পে উৎপাদন ৪০%–এ নেমে এসেছে। এটি কি বেসরকারি খাতের দোষ?"
তিনি আরও বলেন, এনবিআরের নতুন ৫৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ব্যবসার ওপর চাপ বাড়াবে। "আমরা আশঙ্কা করছি আবারও চাপ বাড়বে। এবার তা উৎসে কর কর্তন বা টিডিএস–এর নামে আসতে পারে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে।"
তিনি প্রশ্ন তোলেন, "এত তড়িঘড়ি কেন? যে এনবিআর সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা এনবিআরকে আগের চেয়েও খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে।"
পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তার বলেন, অর্থনীতির গতি কমলেও স্থিতিশীলতা এসেছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে আরও উদার নীতি গ্রহণ করতে হবে। পাল্টা শুল্কের প্রভাবে রপ্তানি কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনো ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বলে মনে করছেন তিনি।
