ওয়ালটনের বিশ্বযাত্রা: যেভাবে একটি বাংলাদেশি ব্র্যান্ড বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে

২০১০ সালে বাংলাদেশের স্থানীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড ওয়ালটন যখন কাতারে তাদের প্রথম রেফ্রিজারেটরের চালান পাঠায়, তখন খুব কম মানুষই তাদের বিশ্বজয়ের স্বপ্নের বিশালত্ব কল্পনা করতে পেরেছিল। এর ১৫ বছর পর, ২০২৫ সালে এসে ওয়ালটন বাংলাদেশের প্রধান বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও ওশেনিয়াজুড়ে ৫০টির বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।
সাদামাটা সূচনা থেকে ওয়ালটন আজ উদ্ভাবন, স্থানীয়করণ ও গুণগত মানের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে বিশ্বমানের ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের এই যাত্রা শুধু একটি কোম্পানির উত্থানের গল্প নয়, বরং বিশ্বজুড়ে উৎপাদন শিল্পে বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান পদচিহ্নেরও প্রতিফলন।
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটি গত পাঁচ বছরে ৩ লাখ ৫৫ হাজার ইউনিট রেফ্রিজারেটর রপ্তানি করেছে। বর্তমানে ওয়ালটন বিদেশে ১০ হাজারেরও বেশি বিক্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, ওয়ালটন সম্প্রতি ভারতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। শুধু এ বছরেই দেশটিতে ৩০০টি নতুন শোরুম খুলে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে।
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুবুল আলম বলেন, 'আমরা কাতার ও মিয়ানমার দিয়ে রপ্তানি শুরু করেছিলাম। এটা ছোট পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়—ওয়ালটনকে একটি সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করা।'
এরপর থেকে ওয়ালটনের রপ্তানি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সুদানে প্রবেশ করে ব্র্যান্ডটি। এরপর ২০১৫ সালে ভারত, নেপাল ও মালদ্বীপে এবং ২০১৯ সালের মধ্যে তুরস্ক, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও আয়ারল্যান্ডের মতো বড় বাজারেও জায়গা করে নেয়। ২০২৫ সাল নাগাদ কোম্পানিটি ৫০টিরও বেশি দেশে পণ্য রপ্তানি করছে৷ রপ্তানি বাজারগুলোর মধ্যে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সিঙ্গাপুর, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ।
মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, 'আজ ইউরোপের পরিবারে, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের কাছে, আফ্রিকার দোকানদারদের এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঘরে ঘরে ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর ব্যবহৃত হচ্ছে।'
সীমানা ছাড়িয়ে পথচলা
ওয়ালটন কেবল বিতরণ নেটওয়ার্কই তৈরি করেনি, পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে স্থানীয় কার্যালয় ও অংশীদারত্বও স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় তাদের বিক্রয় কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে চালু আছে গবেষণা ও উদ্ভাবন (আরঅ্যান্ডআই) কেন্দ্র।
ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর পণ্যের চিফ বিজনেস অফিসার মো. তাহাসিনুল হক বলেন, 'এই বৈশ্বিক উপস্থিতি আমাদের গ্রাহকদের কাছাকাছি থাকতে, স্থানীয় পছন্দ বুঝতে এবং দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যেমন, ইউরোপের জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী পণ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, আবার দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর জন্য ছোট আকারের মডেল বেশি উপযোগী। আমরা সেভাবেই পরিবর্তন আনি।'
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মূল শক্তি
ওয়ালটনের সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশে অবস্থিত বিশাল উৎপাদন কেন্দ্র, যেখানে কম্প্রেসার থেকে শুরু করে একটি রেফ্রিজারেটরের পূর্ণাঙ্গ রূপদান, এমনকি স্ক্রুর মতো ছোট ছোট উপাদান পর্যন্ত তৈরি হয়। এর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা এখন ৩৫ লাখ ইউনিট, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ওয়ালটন আন্তর্জাতিক মানের গুরুত্বপূর্ণ সনদ, যেমন আইএসও, সিই, সিবি, জিসিসি ও ইউএল অর্জন করেছে, যা তাদের অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।
ওয়ালটনের সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা ও উদ্ভাবন) আজমল ফেরদৌস বলেন, 'ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমরা কম্প্রেসার, পিসিবি বোর্ড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নিজেরাই তৈরি করি। এটি শুধু উৎপাদন খরচই কমায় না, বরং পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণেও আমাদের পূর্ণ ক্ষমতা দেয়।'
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: সাফল্যের মূলমন্ত্র
ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটরে এখন 'এআই ডক্টর', এইট-ইন-ওয়ান কনভার্টিবল মোড, ইন্টেলিজেন্ট জার্ম টার্মিনেশন ও স্মার্ট ডিসপ্লের মতো ইন্টারনেট অভ থিংস (আইওটি) ও এআই-নির্ভর বিভিন্ন ফিচার যুক্ত হয়েছে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এখন তাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে। ওয়ালটন আর৬০০এ রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এর প্রভাব কমায়। ক্ষতিকর রেফ্রিজারেন্ট পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার জন্য ওয়ালটনই প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি, যারা ইউএনডিপি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে অংশীদারত্ব করেছে। এছাড়া ইনভার্টার কম্প্রেসার, ন্যানো-সিলভার প্রযুক্তি ও উন্নত ফোমিং পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়েছে।
ওয়ালটনের গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক সিকদার বলেন, 'এখনকার গ্রাহকরা বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও টেকসই পণ্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। আমরা চাই ওয়ালটনের পণ্য শুধু পারফরম্যান্সের জন্যই নয়, পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণেও যেন স্বতন্ত্র পরিচিতি লাভ করে।'
প্রতিটি মডেলকে কঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাস্তব পরিস্থিতির আদলে এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য ১৬টি শীতলীকরণ পরীক্ষা ও ৩৬টি নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয়।
গবেষণা ও উন্নয়ন
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত ওয়ালটনের আরঅ্যান্ডআই কেন্দ্রগুলোতে ২৫০ জনেরও বেশি প্রকৌশলী কাজ করছেন। জলবায়ু-উপযোগী প্রযুক্তি, এআইয়ের সমন্বয় ও অটোমেশন নিয়ে কাজ করা তাদের মূল লক্ষ্য।
ওয়ালটনের রেফ্রিজারেটর পণ্যের চিফ বিজনেস অফিসার মো. তাহাসিনুল হক বলেন, 'আমাদের উদ্ভাবনগুলো অনুকরণ করা নয়, বরং দেশীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। যেমন, আমাদের আইওটি রেফ্রিজারেটরগুলো সরাসরি সার্ভিস সেন্টারে ডায়াগনস্টিকস বা ত্রুটির তথ্য পাঠাতে পারে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকদের জন্য যন্ত্রটি অকার্যকর থাকার সময় কমিয়ে আনে।'
এটি শুধু গবেষণা প্রতিষ্ঠানই নয়, বিশাল কর্মসংস্থানের উৎসও বটে। দেশে-বিদেশে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ এখানে কর্মরত; প্রতিষ্ঠানটি দেশের শিল্প খাতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ওয়ালটনের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মো. কাউসার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'বিদেশে পাঠানো প্রতিটি রেফ্রিজারেটর শুধু ওয়ালটনের নামই বহন করে না, হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিকের স্বপ্নও বয়ে নিয়ে যায়।'
বাজার সম্ভাবনা
২০২৩ সালের হিসাবে বিশ্বজুড়ে রেফ্রিজারেটরের বাজার প্রায় ১৩০ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের। ওয়ালটনের কর্মকর্তারা মনে করেন, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে এই বাজারের ১ থেকে ৩ শতাংশ দখল করা বাস্তবিকভাবে সম্ভব।
ওয়ালটনের ভাইস প্রেসিডেন্ট (গ্লোবাল বিজনেস) আব্দুর রউফ বলেন, 'শুনতে কম মনে হলেও, ১ শতাংশ বাজার হিস্যার অর্থ হলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আয়।'
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান খরচ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো চীনা সরবরাহকারীদের বিকল্প খুঁজছে। পণ্যের গুণগত মান, সাশ্রয়ী মূল্য ও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে সেই বিকল্প হিসেবে ওয়ালটন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
আব্দুর রউফ আরও বলেন, 'শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পূর্ব আফ্রিকাকে ওয়ালটন সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির অঞ্চল হিসেবে বিশেষভাবে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা এবং সাশ্রয়ী ও বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী যন্ত্রের প্রতি আগ্রহ এই অঞ্চলগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।'
সরকারি প্রণোদনা
ওয়ালটনের বিশ্বজয়ের গল্পের পেছনে সরকারি সহায়তার ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা দুটোই স্পষ্ট। প্রথমদিকে বাংলাদেশ সরকার রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিত, যা এখন কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হলে এ ধরনের প্রণোদনা পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া হতে পারে।
এস এম মাহবুবুল আলম বলেন, 'আমরা প্রণোদনার ওপর নির্ভর করতে চাই না। আমাদের লক্ষ্য হলো যোগ্যতা, প্রযুক্তি ও ব্র্যান্ডের শক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রতিযোগিতা করা। তবে একইসাথে আমরা আশা করি, সরকার বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি তৈরিতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে।'