ব্যাপক শুল্ক হ্রাস: স্থানীয় শিল্পের বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

আগামী বছর নভেম্বরেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের। এই প্রেক্ষাপটে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কবৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ৫০০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এমন কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, যার কারণে স্থানীয় আমদানি বিকল্প শিল্পগুলো বাড়তি প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে।
তারা বলছেন, এলডিসি-পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও যেসব পণ্যে দেশেও উৎপাদন হয়, সেগুলোর শুল্ক কমানোয় ওই খাতগুলোর শিল্প প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ হতে পারে।
যেসব পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—আমদানিকৃত প্লাস্টিক পণ্য, কিচেনওয়্যার, টয়লেটপেপার, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের ফ্যাব্রিক। বিভিন্ন তৈরি পোশাক ও জুতার ওপর শুল্ক ৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। আর ব্রিক, ব্লক ও টাইলসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং আমদানি করা মাছ ও মাংসের ওপরেও শুল্ক কমানো হয়েছে।
এসবের বাইরে যেসব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে, সেগুলোর বড় অংশই অপ্রচলিত পণ্য্য, যা তেমন আমদানি হয় না। অর্থাৎ বাজারে এদের উপস্থিতি সীমিত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমদানিতে যে উচ্চ শুল্ক ছিল, তা কমানোর যুক্তি ছিল। তবে এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ের আমদানি বিকল্প শিল্পও বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে যাচ্ছে।'
'শুল্ক কমানোর বিষয়টি যথাযথ গবেষণা করে এবং বাণিজ্যনীতি বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে কি না, বিশেষত উদীয়মান শিল্পের বিষয়টি মাথায় ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
এবারের বাজেটে ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও ৬৫টি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি কমানো হয়েছে। ৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে এবং ৪৪২টি পণ্যে তা আংশিকভাবে কমানো হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলেন, বিগত তিন বছর ধরে শুল্ক কমানো হলেও এবারের বাজেটেই সবচেয়ে বেশি পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে।
শুল্ক ছাড়াও সরকার এবারে আমদানি মূল্যায়নের (ইমপোর্ট ভ্যালুয়েশন) দীর্ঘদিনের অসামঞ্জস্য দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েকশো পণ্যে 'ট্যারিফ ভ্যালু' ও 'মিনিমাম মূল্য' আরোপ করা হয়, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ৮৪টি পণ্যে 'মিনিমাম ভ্যালু' প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্যের ওপর এখন প্রকৃত আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে কর ধার্য হবে, সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের ভিত্তিতে নয়। ফলে বাংলাদেশের শুল্কনীতি এখন ডব্লিউটিও মানদণ্ডের সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, এই মিনিমাম ভ্যালু পদ্ধতি নিয়ে বহুদিন ধরেই সমালোচনা ছিল—কারণ এটি মুক্ত বাণিজ্যের নীতির পরিপন্থী এবং যথাযথ মূল্যায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
মিনিমাম ভ্যালু হলো কাস্টমস মূল্যায়নের জন্য সরকার-নির্ধারিত একটি মূল্য। কোনো পণ্য ওই ভ্যালুর চেয়ে কম মূল্যে আমদানি করা হলেও সরকার-নির্ধারিত মূল্যের নিচে অ্যাসেসমেন্ট হবে না। এছাড়া বেশ কিছু পণ্যে ট্যারিফ ভ্যালুও রয়েছে। ঘোষিত আমদানি মূল্য যা-ই হোক না কেন, এসব পণ্যে পূর্বনির্ধারিত হারে শুল্ক আরোপ করা হয়।
এনবিআরের কাস্টমস উইংয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'বাংলাদেশ যেহেতু এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট করতে যাচ্ছে, তাই আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের ভ্যালুয়েশনের এ ধরনের বিকৃতি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়।'
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এগুলো থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন বহু বছর ধরে। এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের অংশ হিসেবে এবার বড় আকারে পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। এর ফলে দেশের স্থানীয় শিল্পকে যে উচ্চ শুল্ক-প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা কিছুটা কমবে।'
অবশ্য এত বেশি শুল্ক কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় খুব বেশি কমবে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, 'কিছু পণ্যের শুল্ক, মিমিনাম ভ্যালু, সম্পূরক ডিউটি, কাস্টমস ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে আমদানিতে রাজস্ব আদায়ে তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।'