জুলাইয়ের পর সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৫৬ শতাংশ: বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রমের পরিমাণ ৫৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
মঙ্গলবার (২৭ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএফআইইউ'র বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত মোট ২৭ হাজার ১৩০টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত রিপোর্ট (এসটিআর/এসএআর) জমা পড়েছে। অন্যদিকে ২০২৩–২৪ অর্থবছর জুড়ে এমন রিপোর্ট ছিল ১৭ হাজার ৩৪৫টি।
এই প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, গত বছরের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের পর আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঘটনার পর থেকেই ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম বাড়তে থাকে।
বিএফআইইউ-এর তথ্যমতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং বিএফআইইউ প্রধান এএফএম শাহিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরেন বিএফআইইউ পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থাকে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন সরবরাহ করেছে এবং ১,২২০টি তথ্য বিনিময় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.৯১ শতাংশ বেশি।
সংস্থাটি জানিয়েছে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ২০২৪ সালের 'বেসেল এএমএল ইনডেক্স'-এ বাংলাদেশ ১৩ ধাপ উন্নতি করে ৫৯তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
বিদেশে জব্দকৃত সম্পদ ফেরাতে 'সক্রিয়ভাবে কাজ করছি': গভর্নর
সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশে জব্দ হওয়া সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে যেন এসব অর্থ অন্য দেশে চলে না যায়। আমাদের আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশি আদালতকে বোঝাতে চাই যে এসব অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত। প্রমাণ করতে পারলে আদালত তা ফেরতের নির্দেশ দেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সঙ্গে একজন কাজ করছেন, যিনি বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের এবং তার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি ছয় মাস আমাদের সঙ্গে থেকে প্রতিটি কেস খতিয়ে দেখবেন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বসে সমাধান খুঁজবেন।'
গভর্নর বলেন, 'আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। তারপরও যদি কেউ অভিযোগ করেন যে আমরা কিছু করছি না—তাহলে সেটি আমাদের অভ্যন্তরীণ উদ্যোগের অভাব। শুধু দোষারোপ না করে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশের জন্য যদি বিদেশি সহায়তা লাগে বা অর্থ লাগে, তাহলে সেটি অবশ্যই নেওয়া উচিত। কিন্তু খালি অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই।'
'ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না'
গভর্নর জানান, মানি লন্ডারিং আইনে সংশোধনী এনে একটি টাস্কফোর্সকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে প্রতি সংস্থা থেকে একজন প্রতিনিধি থাকবেন এবং তারা সরকারি ক্ষমতা ও দায়বদ্ধতার মধ্যে থেকে প্রতি সপ্তাহে মিটিং করবেন।
৫ আগস্ট থেকে যেসব ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য অভিযোগ ছিল এবং আদালতের আদেশ অনুযায়ী তা করা হয়েছে বলে জানান গভর্নর।
তিনি বলেন, 'আমরা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট বেশি ফ্রিজ করেছি। ব্যবসা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
গভর্নর বলেন, 'প্রথম থেকেই আমরা বুঝেছি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা কোনোভাবেই ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই না। বরং ব্যবসার স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চাই।'
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে বলে জানান গভর্নর।
তিনি বলেন, 'একজন ব্যক্তি ৩৫০টি বাড়ি কিনেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে, যা আমরা উদ্ঘাটন করতে পেরেছি। দিন দিন এই অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।'
গভর্নর আরও বলেন, 'পাচারের অর্থ ফেরত আনতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। ইতোমধ্যে একজনের বিদেশি সম্পদ জব্দ হয়েছে। সামনে আরও সম্পদ জব্দ হবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাচারকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে আদালতের বাইরে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করা যায়। কাউকে জেলে নিয়ে হয়রানি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারও ব্যবসা বন্ধ করা আমাদের লক্ষ্য নয়।'
তিনি আরও জানান, 'আমরা কারও ব্যবসা বন্ধ করিনি। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, তা অন্য কারণে হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ গতিশীল করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানোর চেষ্টা চলছে। সে জন্য আইনে পরিবর্তন আনা হবে। বর্তমানে ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে।'