এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন জোরদার; বন্দর অচল, বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধের আশঙ্কা

গতকাল শনিবার দেশের প্রধান প্রধান বন্দরগুলোতে আমদানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। কারণ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দেওয়ার সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কর্মকর্তারা আন্দোলন জোরদার করেছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ব্যবসায়ীরা সম্পূর্ণ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। শিল্পসংশ্লিষ্টরা এর ফলে গুরুতর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
এনবিআর কর্মকর্তাদের প্ল্যাটফর্ম 'এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ' ঘোষণা করেছে, আগামীকাল (২৬ মে) থেকে আমদানি-রপ্তানির ছাড়পত্রসহ সব ধরনের শুল্ক কার্যক্রম স্থগিত রাখা হবে। কেবল আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহন এর আওতামুক্ত থাকবে। তারা জানিয়েছে, সরকার যদি তাদের দাবি না মানে, তবে এ কর্মসূচি কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। সেখানে গতকাল (২৪ মে) বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমদানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিল। বেনাপোল কাস্টম হাউসও কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। তবে ঢাকা কাস্টম হাউসে সীমিত পরিসরে কাজ চলছে। পাশাপাশি সারাদেশেই কর ও ভ্যাট অফিসের কার্যক্রমও স্থগিত রয়েছে।
এই হঠাৎ অচলাবস্থায় বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় বিদেশি ক্লায়েন্টরা যোগাযোগ করছেন। শিল্প নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, যদি এই ব্যাঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, শনিবার আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং সোমবার থেকে পুরোপুরি স্থগিতাদেশ কার্যকর হতে পারে। তিনি বলেন, 'যদি তা-ই হয়, তাহলে প্রতিদিন অর্থনীতিতে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। চালান আসতে না পারায় অর্ডার বাতিল ও মূল্যছাড় না পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিচ্ছে। এতে করে আমাদের বিশ্ববাজারে সুনাম চরম ঝুঁকিতে পড়বে।'
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ খানও এই উদ্বেগের কথা বলেছেন। তিনি জানান, 'শনিবার থেকে আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক ছাড়পত্র সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রপ্তানি কার্যক্রম কেবল রবিবার পর্যন্ত চালু থাকবে। সোমবার থেকে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে। যদি তা-ই হয়, আমরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ব।' তিনি জানান, এক কোরিয়ান ক্রেতা ইতোমধ্যে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং পণ্য পেতে দেরি হতে পারে বলে ধারণা করছেন। তিনি একে 'বিদেশে এক ভয়াবহ সংকেত' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বন্দর কার্যক্রমে প্রভাব
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার সাইদুল ইসলাম জানান, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধর্মঘট চলার সময় সব ধরনের আমদানি মূল্যায়ন বন্ধ ছিল। বিকেল ৫টার পর সীমিতভাবে কার্যক্রম শুরু হয়, যদিও সারাদিন রপ্তানি কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।
দেরির কারণে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম সাইফুল আলম বলেন, 'ধর্মঘটের কারণে বন্দর কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। যানজট ও স্টোরেজ ফিসহ নানা কারণে আমদানিকারকদের বিশাল ব্যয় গুনতে হচ্ছে।'
কাস্টম হাউস ঢাকার কমিশনার মো. জাকির হোসেন বলেন, রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। পচনশীল ও জরুরি পণ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। তবে বেনাপোলে ক্লিয়ারিং এজেন্ট নূর হোসেন জানান, একটি পোশাকের চালান কাস্টমসে শুল্কায়নের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৩.২ মিলিয়ন আমদানি-রপ্তানি বোঝাই ও খালি কনটেইনার পরিচালিত হয়। ২০২৪ সালে বন্দরটি ৩.২৭৬ মিলিয়ন টিইইউ (কুড়ি-ফুট সমতুল্য একক) কনটেইনার এবং ১২৪ মিলিয়ন টন পণ্য প্রক্রিয়াজাত করেছে। এই সময়ে বন্দরে ভিড়েছে ৩ হাজার ৮৬৭টি বাণিজ্যিক জাহাজ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৭৮.৭ মিলিয়ন টন পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে আমদানিকৃত ৭৪ মিলিয়ন টনের চেয়ে বেশি। এ দশ মাসে কাস্টম হাউসটি ৬২ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। দৈনিক গড় আদায় ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৮ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা।
এদিকে, ১৩ মে থেকে ১৯ মে বিকেল ৩টা পর্যন্ত আমদানি ছাড়পত্র স্থগিত থাকায় বন্দরে ৪ হাজারের বেশি কনটেইনার আটকে পড়েছে।
দাবিতে অনড় কর্মকর্তারা
শনিবার ঢাকায় আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সদর দপ্তরের সামনে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের শত শত কর্মকর্তা জড়ো হন। এক সংবাদ সম্মেলনে তারা আবারও তাদের দাবিসমূহ পুনর্ব্যক্ত করেন—এনবিআর ভেঙে দেওয়া-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণ, রাজস্ব সংস্কার কমিটির সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ এবং যেকোনো সংস্কারের আগে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা।
একজন মুখপাত্র বলেন, অর্থনীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে এবং অর্থবছরের শেষদিকে রাজস্ব আদায় সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে একটি স্পষ্ট ঘোষণা প্রয়োজন। তিনি জানান, তাদের দাবি মানা হলে অবিলম্বে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে এবং অনিষ্পন্ন কার্যক্রম অতিরিক্ত সময় কাজ করে সম্পন্ন করা হবে।
শনিবার এনবিআর সদর দপ্তরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ভবনের বাইরে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। কেবল বৈধ পরিচয়পত্রধারী কর্মচারীদের ভবনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল।
'এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ' ১৪ মে থেকে কলম-বিরতি শুরু করেছিল, যা ১৯ মে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় সরকারের আলোচনার প্রস্তাবের পর স্থগিত করা হয়।
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, 'কর্মকর্তাদের দাবি যদি যৌক্তিক হয়, তাহলে সরকারের উচিত তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা।' তিনি মনে করেন, বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে হলে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধানে পৌঁছানো দরকার।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, প্রয়োজনে অধ্যাদেশটি স্থগিত রাখা উচিত যতক্ষণ না সমাধান পাওয়া যায়। তার মতে, এই অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার প্রভাবে তারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, যেভাবে অধ্যাদেশটি পাস হয়েছে এবং যেভাবে কর্মকর্তারা বাণিজ্য কার্যক্রমকে কার্যত জিম্মি করে রেখেছেন—উভয়ই উদ্বেগজনক।