ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাত দেখতে পেয়েছে বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের এক ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৫২ আবেদনকারী থেকে বেছে নগদ ও কড়ি—এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল এবং এতে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতের আভাস পাওয়া যায়।
'বাংলাদেশ: কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অস্পষ্টতা দেশের বেসরকারি খাতের অগ্রগতির বড় বাধা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'চুক্তি ও লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।' বিশ্বব্যাংক গ্রুপের দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান—ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) ও মাল্টিল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ)—এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে প্রতিবেদনটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, যেখানে 'কিছু আবেদনকারীকে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত লাইসেন্স দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, আর অন্যদের একটি অস্পষ্ট "ডিজিটাল ব্যাংকিং উইন্ডো" দেওয়া হয়েছে।'
২০২৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী 'নগদ'-এর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত নগদ ডিজিটাল ব্যাংক এবং এসিআই গ্রুপের সমর্থিত কড়ি ডিজিটালকে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) ইস্যু করে।
নগদের হাসিনার আশীর্বাদ পাওয়ার অভিযোগ
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের জন্য পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে এমএফএস কার্যক্রম শুরু করে নগদ। অল্প সময়েই এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এমএফএস প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে একচেটিয়া সরকারি চুক্তি পাওয়ায় এই দ্রুত উত্থান সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আনুষ্ঠানিক এমএফএস লাইসেন্স না থাকলেও, নগদের ৯ কোটির বেশি গ্রাহক রয়েছে—যার পেছনে শেখ হাসিনা সরকারের একচেটিয়া চুক্তিগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ।
শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণেই প্রতিষ্ঠানটি এমন একটি একচেটিয়া চুক্তি পায়, যার ফলে সরকারি লেনদেনে একমাত্র প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নগদ প্রতিষ্ঠা পায়। এতে গ্রাহকদের বিকল্প এমএফএস সেবাদাতা বেছে নেওয়ার সুযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স চালু করে, যা নগদের চাপের ফলেই হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানটি এমএফএস থেকে ডিজিটাল ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার চেষ্টা করছিল।
২০২৪ সালের ৩ জুন চূড়ান্ত লাইসেন্স পাওয়ার পর, নগদ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন প্রধান নির্বাহী তানভীর এ মিশুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, ব্যাপক নগদবিহীন লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিতে ডিজিটাল ব্যাংকই সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম।'
বিকাশের প্রতি বৈষম্য
অন্যদিকে, দেশের শীর্ষস্থানীয় এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকে পরিণত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ কড়িকে লাইসেন্স দেওয়া হয়, যদিও প্রতিষ্ঠানটির আগে এ খাতে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক, ডিজিটেন এবং ডিজিটাল ব্যাংক নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানে 'ডিজিটাল ব্যাংকিং উইন্ডো' চালুর অনুমতি দেয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা নির্দেশিকা থাকলেও, বাস্তবে খুব সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে। ডিজিটেন ১০টি ব্যাংকের একটি কনসোর্টিয়াম পরিচালনা করে, আর ডিজিটাল ব্যাংক পায় ব্যাংক এশিয়ার সহযোগিতা।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স স্থগিত করে।
পরবর্তীকালে আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দেন।
এদিকে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে এলওআই পাওয়া কড়ি ডিজিটাল চূড়ান্ত লাইসেন্স নিশ্চিত করতে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে ব্যর্থ হয়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কড়ি ডিজিটালের একজন স্পনসর আনিস এ খান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এক মাস আগে ফি-সহ প্রয়োজনীয় সব নথিপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, 'আমরা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়ান্ত লাইসেন্স অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছি।'
আনিস খানের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ৭২ কোটি টাকা প্রযুক্তি সহায়তা হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আসার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
নির্ধারিত সময়ে নথি জমা দেয়নি কড়ি
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে পৃথক এক আলাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কড়ি এলওআই পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বাধ্যতামূলক সব নথি জমা না দিলেও, কোম্পানিটি এখনো সম্মতির পর্যায়ে রয়েছে বলেই বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এটি প্রয়োজনীয় তথ্য ধাপে ধাপে জমা দিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে কড়ির মূলধন কাঠামো যাচাই করছে। কোম্পানিটি এটির মূলধনের একটি অংশ নগদের পরিবর্তে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ফলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ নগদ-বহির্ভূত অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য বিকাশের আবেদন
দেশের অন্যতম মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী বিকাশ, যারা ২০২৩ সালে একটি ডিজিটাল ব্যাংকিং উইন্ডো চালুর জন্য বিকাশকে মৌখিক অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক, তবে এব্যাপারে তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন চিঠি দেয়নি এবং এসংক্রান্ত কোনো প্রক্রিয়াও শুরু করেনি। বিকাশ-সহ আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানকে উইন্ডো চালুর অনুমোদন দেওয়ার কথা বলা হলেও- কাউকেই কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি।
উইন্ডো চালুর জন্য একটি গাইডলাইন জারির কথা থাকলেও- সেটিও করা হয়নি।
বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর জানান, ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স মূল্যায়ন প্রতিবেদনে তাদের আবেদন সর্বোচ্চ স্কোর পেয়েছে। তিনি বলেন, 'আমাদের আবেদনটি এখনো সক্রিয় আছে, যদি রেগুলেটর লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে, তাহলে বিকাশ পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ করে গ্রাহকদের আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত থাকবে।'
ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্সের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, ৫ আগস্ট থেকে এ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। তিনি যোগ করেন, 'নতুন লাইসেন্স প্রদান পুনরায় শুরু করা কিংবা উইন্ডো লাইসেন্সধারীদের জন্য আলাদা নির্দেশিকা জারি করার বিষয়ে এখনো কোনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।'
তিনি কড়ির প্রয়োজনীয় নথি সময়মতো জমা না দেওয়ার বিষয়টি এবং নগদের লাইসেন্স স্থগিত হওয়ার তথ্যও নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাব থাকায় ডিজিটাল ব্যাংকিং উইন্ডো পরিচালনার জন্য নির্দেশিকা জারি করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
বিশ্বব্যাংক এটির সাম্প্রতিক ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, 'যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স চালু করেছে, বহু আবেদন জমা পড়লেও অল্পসংখ্যক লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো নন-ব্যাংক ফিনটেক এবং এমবেডেড ফাইন্যান্স প্রোভাইডারদের অন্তর্ভুক্ত করে ডিজিটাল লাইসেন্সিং ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করেনি।'
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, 'এই ধরনের ডিজিটাল এনবিএফআই অনেক উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে আর্থিক সেবায়, বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের ক্ষেত্রে, ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে ফিনটেক ও এমবেডেড অর্থায়নে বিনিয়োগ আকর্ষণে একটি স্বচ্ছ নিয়ন্ত্রক কাঠামো সহায়ক হবে।'
লাইসেন্সের জন্য বিবেচনায় ছিল তিন আবেদনকারী
জানা গেছে, নগদ ও কড়ির ছয় মাসের কার্যক্রম মূল্যায়নের পর আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান—জাপান বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক, নর্থ ইস্ট ডিজিটাল ব্যাংক ও স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংক—লাইসেন্সের জন্য বিবেচনায় ছিল।
এর মধ্যে জাপান বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি একটি যৌথ উদ্যোগ, যার অংশীদার জাপানের আর্থিক স্থানান্তর ও প্রিপেইড পেমেন্ট ইন্সট্রুমেন্ট ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান জাপান রেমিট ফাইন্যান্স এবং কয়েকটি স্থানীয় কোম্পানি ও ব্যক্তি।
তবে, নগদ ও কড়ির অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তাদের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়াও স্থগিত রাখা হয়েছে।