বাণিজ্যযুদ্ধ ও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন: বিশেষজ্ঞরা বলছেন উচ্চ শুল্ক কমানোর এখনই উপযুক্ত সময়

দেশের পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা হলেও রাজস্ব কমে যাওয়ার ভয়ে এতদিন তা সংস্কারের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তবে বিশ্ববাণিজ্যের পরিবর্তনশীল গতিপথ এবং আগামী বছরেই বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে এখনই শুল্ক কমানোর উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, মূল উদ্বেগের বিষয় হলো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। বিশ্ববাণিজ্যে, বিশেষত রপ্তানি বাণিজ্যে নিজেদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশকে শুল্কনীতি বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে হবে।
সরকার ইতিমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দেওয়া চিঠিতে দেশটি থেকে বেশি আমদানি হওয়া প্রায় ১০০ পণ্যের শুল্ক অর্ধেক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে কোন ধরনের পণ্যে শুল্ক কমানো হবে, তার তালিকা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে দেশটি থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই আমদানির একটি অংশ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আসে। তবে শুল্ক রয়েছে, এমন তালিকায় বেশি আমদানি হয় স্ক্র্যাপ, যা দিয়ে মূলত ইস্পাতপণ্য তৈরি হয়। এর উপর অ্যাড ভ্যালোরেম হিসেবে আমদানি শুল্কের হার ১.৫ শতাংশ। এই পণ্যের আমদানিতে সরকার শিগগিরই শুল্ক অর্ধেক কমাতে পারে।
তবে ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী, এই শুল্ক কমানো হলে, তা যে কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রেই কমবে তা নয়। বরং একই পণ্য অন্য যেকোনো দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক কমবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর (পিআরআই) চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার বলেন, 'আমদানি শুল্ক যৌক্তিক করার এখনই উপযুক্ত সময়।' বিষয়টি ইতিমধ্যে তারা সরকারকে জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একই কথা বলছেন ব্যবসায়ীরাও। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, উচ্চ শুল্কের কারণে বাংলাদেশর আমদানি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভোক্তাদেরও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
এখনও শুল্ক নির্ভরতা বেশি
বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের গড় আমদানি শুল্ক ২৭ শতাংশের ওপরে—যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। বাংলাদেশের এই শুল্কহার এলডিসিগুলোর গড় হারের তুলনায়ও অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৈরি করা পিআরআইয়ের গবেষণা প্রতিবেদনন বলছে, নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর গড় শুল্ক ১১ শতাংশ, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গড় শুল্ক ৭ শতাংশ, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে গড় শুল্ক ৫ শতাংশ এবং উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে গড় শুল্ক ৩ শতাংশ।
পিআরআইয়ের প্রাক্কলন অনুসারে, কেবল ২০২৪ সালেই বাংলাদেশের ভোক্তাদেরকে চড়া শুল্কের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের জন্য বৈশ্বিক গড় মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি গুনতে হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলো উদারীকরণের দিকে এগোলেও বাংলাদেশ এখনও আমদানি শুল্ক থেকে তার রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ আহরণ করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানি শুল্ক থেকে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছে।
স্বল্প মাত্রায় সমন্বয়ের প্রভাব কম
অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরে বাংলাদেশ এশিয়া-ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বাজারে রপ্তানিতে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না।
প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে অন্য দেশকেও একই সুবিধা দিতে হবে। অর্থাৎ ওইসব দেশের পণ্য আমদানিতেও বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে।
এজন্য ধীরে ধীরে আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনার জন্য অর্থনীতিবিদরা গত কয়েক বছর ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু রাজস্ব কমে যাওয়ার ভয়ে এনবিআর তাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এত বছরেও নেয়নি। কিছু পণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু এবং শুল্ক কমানো হলেও বাস্তবে ওইসব পণ্যের আমদানির পরিমাণ খুবই কম। ফলে বাস্তবে তেমন প্রভাব পড়েনি।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের এক আলোচনা সভায়ও বিষয়টি এসেছে। সেখানে ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর (এফবিসিসিআই) প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাাগিয়ে সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমানোর সুযোগ এসেছে।
'ট্যারিফ কমানোর ভালো সময় এসে গেছে,' বলেন তিনি।
৮০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক
বাংলাদেশ এখনও কিছু পণ্যে বিশ্বের সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ করে।
কিন্তু আমদানিকৃত ফলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও উচ্চ হারে শুল্ক রয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতি ১০০ টাকার আমদানিকৃত ফলে প্রায় ১৩০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। আর পোশাক, জুতা, প্রসাধনিসহ আরও কিছু পণ্যে ৯০ শতাংশের ওপরে কর রয়েছে।
১০০টিরও বেশি ভোগ্যপণ্যের আমদানি শুল্ক ১০০ শতাংশ থেকে ২৭৮ শতাংশ। এ তালিকায় রয়েছে পানীয়, এয়ার কন্ডিশনার, প্রাকৃতিক গ্যাস, সিরামিক, শ্যাম্পু, এলইডি লাইট, প্লাস্টিক পণ্য ও জুতা।
স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার নামে আমদানি পণ্যে এই চড়া শুল্কের দেওয়াল দেওয়া আছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই চড়া চল্কা প্রতিযোগিতাকে সংকুচিত করে দেওয়ার পাশাপাশি ভোক্তাদের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগও সীমিত করে দেয়।
সম্পূরক শুল্ক
আরেকটি বড় উদ্বেগ হল সম্পূরক শুল্কের (এসডি) বৈষম্যমূলক প্রয়োগ। এ শুল্ককে বাণিজ্য-নিরপেক্ষ মনে করা হলেও আমদানিতে ৯০ শতাংশের বেশি সম্পূরক শুল্ক হয় দেশীয় পণ্যের ওপর ধরা হয় না অথবা কম হারে আরোপ করা হয়।
পিআরআইয়ের জাইদি সাত্তার বলেন, এই ভারসাম্যহীনতার অন্যতম কারণ প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর তদবির। তিনি আরও বলেন, এই ধরনের চর্চা অব্যাহত রাখলে বাণিজ্য বিরোধ দেখা দিতে পারে বা আন্তর্জাতিক অংশীদাররা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে।
এনবিআরের তথ্যমতে, সাড়ে ৭ হাজার ট্যারিফ লাইনের মধ্যে ১ হাজার ৬৬০টিতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই সম্পূরক শুল্কের হার হয় ২০ শতাংশ।
জাইদি সাত্তার বলেন, শুল্ক যৌক্তিক করা কেবল অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয় নয়—দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক রাখার জন্য এটি অপরিহার্য।