পুঁজিবাজারে নেগেটিভ ইক্যুটির বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি ৭,৮২৪ কোটি টাকা

গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পুঁজিবাজারের নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রভিশনিং ঘাটতি ৭ হাজার ৮৬২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
মোট ১০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকার নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে মাত্র ২ হাজার ৭০১ কোটি টাকা প্রভিশনিং করতে পেরেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নেগেটিভ ইক্যুইটির বিপরীতে প্রভিশন রাখার ঐচ্ছিক সুবিধার সময়সীমা শেষ হয়েছে। ধাপে ধাপে প্রভিশনিংয়ের সুবিধার চেয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)।
সূত্রমতে, ২০১৬ সাল থেকে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও প্রভিশন করতে ব্যর্থ হয়েছে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো।
এই পরিস্থিতিতে নেগেটিভ ইক্যুইটির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ওই চিঠিতে ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মার্জিন ঋণ ও নেগেটিভ ইক্যুটির অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার থেকে বিদ্যমান নেগেটিভ ইক্যুইটি অবলোপন না করা হলে বাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা এবং পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনা খুব কঠিন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মার্জিন ঋণ বিধিমালা সংস্কার এবং বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অবিলম্বে এক বা একাধিক আর্থিক পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
চিঠিতে বিএসইসি বলেছে, '২০১০ সালে পুঁজিবাজারের সিকিউরিটিজের আকস্মিক বড় দরপতন এবং এর পরবর্তী বছরগুলোতে ঘটিত নানা অস্বাভাবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন হিসাবে অনাদায়কৃত ক্ষতি পুঞ্জীভূত হয়ে যায়, যা দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের হিসাবে নেগেটিভ ইক্যুইটি আকারে ক্যারি ফরওয়ার্ড হয়ে আসছে।'
এর আগে কমিশন বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরেও বিদ্যমান নেগেটিভ ইক্যুইটি পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বিগত সময়ে কমিশন পুঁজিবাজার থেকে বিদ্যমান নেগেটিভ ইক্যুইটি অবলুপ্তির উদ্দেশ্যে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনাদায়কৃত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন রাখার নির্দেশনা দেয়, যার সময়সীমা চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি অতিক্রান্ত হয়েছে।
এই অবস্থায় এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ এবং এ-সংক্রান্ত সভা আহ্বান করতে অনুরোধ জানিয়েছে বিএসইসি। কমিশন আশা করছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহযোগিতা ও কার্যকরী পরামর্শ নেগেটিভ ইক্যুইটি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বিএসইসির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'নেগেটিভ ইকুইটির বিপরীতে প্রভিশন রাখার সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি শেষ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন অনাদায়ী ক্ষতির জন্য আবার প্রভিশন রাখতে হবে।'
বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ করেছে। কিন্তু অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিএসইসি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহায়তা চেয়েছে বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সমাধান ছাড়া ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে না এবং বিনিয়োগকারীরা নেগেটিভ ইক্যুইটির বোঝা বহন করতে থাকবেন।
২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ডিএসই ও সিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারোজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ১.৭৪ লাখ মার্জিন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট থেকে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া মোট মার্জিন ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ১২৮.৭০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ডিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়েছে ১১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ও সিএসইর ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিতরণ করেছে ৩৫ কোটি টাকা। এই মার্জিন ঋণের বিপরীতে মোট নেগেটিভ ইক্যুইটি ১০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রকৃত মার্জিন ইক্যুইটি ৭ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা এবং সুদের পরিমাণ ২ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নেগেটিভ ইক্যুইটি ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ও সুদ ১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। ফলে ডিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্রোকারেজ হাউজগুলো মোট প্রভিশন রেখেছে ১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। সিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ ৯ কোটি টাকা এবং সুদ ২১ কোটি টাকা। ফলে সিএসইর সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি টাকা।
অপরদিকে বিএসইসির অনুমোদিত মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ দিয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকৃত নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ ২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং সুদ ১ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মোট নেগেটিভ ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মোট প্রভিশন রেখেছে ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বরে, স্টক ব্রোকাররা পুঁজিবাজারে নেগেটিভ ইক্যুইটি ও অনাদায়কৃত ক্ষতির বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে প্রভিশন রাখার জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল।
২০১৬ সাল থেকে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের মার্জিন অ্যাকাউন্ট এবং ব্রোকারদের ডিলার অ্যাকাউন্টে প্রভিশন রাখার জন্য ঐচ্ছিক সুবিধা ব্যবহার করে আসছে, বিএসইসি যার মেয়াদ বাড়িয়েছে।
পঞ্চমবার বাড়ানো মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি শেষ হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের শুরুতে বিএসইসিকে দেওয়া এক চিঠিতে ডিবিএ ২০৩০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।
প্রস্তাবে ধাপে ধাপে প্রভিশনিং পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে: ২০২৫ সালে ৫ শতাংশ, ২০২৬ সালে ১০ শতাংশ, ২০২৭ সালে ১৫ শতাংশ, ২০২৮ সালে ২০ শতাংশ, ২০২৯ সালে ২৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে বাকি ২৫ শতাংশ।
ডিবিএস আরও প্রস্তাব দিয়েছে, বাজার মধ্যস্থতাকারীদের প্রভিশন শিথিলকরণের সুযোগ নেওয়া বন্ধ করতে নেগেটিভ ইক্যুইটি থাকা অ্যাকাউন্টগুলোকে কোনো বাড়তি মার্জিন ঋণ দেওয়া হবে না। নেগেটিভ ইক্যুইটি অ্যাকাউন্ট থেকে অর্জিত সুদ কোম্পানির আয়ের অংশ হিসেবে গণনা না করার পরামর্শ দিয়েছে ডিবিএ।
এছাড়াও ডিবিএ মার্জিন ঋণ দিয়ে পরিচালকদের শেয়ার কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ একটি নিয়ম চালুর সুপারিশ করেছে। এ নিয়মের আওতায় ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো মার্জিন কল শুরু হলে অনুমোদন ছাড়াই মার্জিন ঋণ বাতিল করতে পারবে।