নিবন্ধন, অর্থায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা সহজ করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ

ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যবসার সনদ নেওয়ার প্রক্রিয়া, অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ সহজ করা এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি এ সেবার দাম কমানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা সহজীকরণে কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলমান বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। তারা জানান, তথ্য সুরক্ষা জোরদার এবং যেকোনো সময়ে ইন্টারনেট বন্ধের বিধান থাকা আইনটিও সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে।
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ইক্যুইটি তহবিল
বিনিয়োগ সম্মেলনে্র 'বাংলাদেশ স্টার্টআপ কানেক্ট' শীর্ষক সেশনে অংশ নিয়ে— দেশের নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য ৯০০ কোটি টাকার একটি ইক্যুইটি তহবিল গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ উদ্যোগ নিয়েছে।
"এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ৮০০-৯০০ কোটি টাকার একটি তহবিল আমরা গঠন করব। মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকের অংশগ্রহণে, তারাই হবেন সেই ইক্যুইটির মালিক। এই অর্থ কেবল সম্ভাবনাময় স্টার্টআপের জন্য ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসাবে ব্যবহার হবে।"
সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেই তহবিল চালু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, "... এটা এক সপ্তাহ সময়ে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা; আমরা সার্কুলার জারি করে দেব।"
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ৫০০ কোটি টাকার আরেকটি তহবিল গঠন করবে, যাতে কেউ চাইলে ইক্যুইটি পায়, কিংবা ঋণ হিসাবেও তহবিল পায়।
বিনিয়োগের পরিবেশ ও বৈশ্বিক পুঁজি আকর্ষণ
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ব্যবসা করার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা করার লাইসেন্স পাওয়াসহ সরকারি লালফিতার দৌরাত্ম্য বেশ রয়েছে। প্রতিবছর বছর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় ব্যবসায়ীদের।
তিনি বলেন, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে ওঠে। আমাদের কি প্রতিবছরেই এই লাইসেন্ট নবায়ন করা দরকার? এটা জন্মসনদের মতো কেন হবে না— যেটা একবার নিলে কোম্পানির জন্য স্থায়ীভাবে চালু থাকবে?
বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে সফল ক্যারিয়ারের পর অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেওয়া আশিক মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশ এক মোড় পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, "আমাদেরকে অবশ্যই স্থানীয় সম্ভাবনা ও বৈশ্বিক পুঁজির মাঝখানের ব্যবধানটা দূর করতে হবে"
ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকারকে আইনি সুরক্ষা প্রদান
বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি–বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব তাঁর বক্তব্যে বলেন, ইন্টারনেট আর কখনো বন্ধ হবে না। ভবিষ্যৎ সরকার যাতে এটা বন্ধ করতে না পারে, আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। টেলিকম অ্যাক্ট ২০০১–এ ইন্টারনেট বন্ধ করার বিধান আছে; আমরা সেটি বাতিল করার জন্য কাজ করছি, যাতে পরবর্তী সরকারগুলো আইনের সুযোগ নিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে।
তিনি বলেন, "আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, বর্তমান সরকার এক মুহূর্তের জন্যও ইন্টারনেট বন্ধ করবে না। আমরা খুব কঠোর পরিশ্রম করছি যাতে ভবিষ্যতের সরকারও ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে।"
তিনি জানান, ইন্টারনেট বন্ধ ঠেকাতে সরকার চারটি পর্যায়ে কাজ করছে। প্রথমত, সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে সরকার। এটা এ সপ্তাহের শেষে চূড়ান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ইন্টারনেট শাটডাউন নিয়ে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস) শুরু করা হয়েছিল, সেটা বন্ধ করা হয়েছে। এনজিএসও (নন-জিওস্টেশনারি অরবিট) লাইসেন্স গাইডলাইনে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তা ছাড়া বিদ্যমান টেলিকম আইনটি পরিবর্তন করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে, যেন ভবিষ্যতে ইন্টারনেট বন্ধের সুযোগ না থাকে।
ইন্টারনেট ব্যবহার মূল্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমরা ইন্টারনেটের দাম কমাব এবং একইসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগের পরিসর বাড়াবো। তাছাড়া আমাদের সরকার ডেটা গভর্নেন্সের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই, ডেটা গভর্নেন্স এবং ইন্টার-অপারেবিলিটি ইতোমধ্যে আইসিটি ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন মাস্টার প্ল্যান এবং আইসিটি রোডম্যাপে ভালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা সব মন্ত্রণালয়কে ইন্টার-অপারেবল বানাব— যাতে মানুষ তাদের ডেটাবেজে প্রবেশ করতে পারে এবং সেবাগুলোর জন্য ডেটা আরও বেশি প্রবেশযোগ্য হবে, যাতে স্টার্ট-আপ এবং ব্যবসায়ীরা আরও বেশি তথ্যের অ্যাক্সেস পায়।"
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন নিয়েও কাজ চলছে
মে মাসে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন চূড়ান্ত করা হবে জানিয়ে ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব বলেন, এজন্য সরকার ব্যবসায়ী, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করছে।
আইনটি কার্যকরের আগে এপ্রিলের শেষদিকে অংশীজনদের সঙ্গে আরও আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
নতুন উদ্যোগের পরিবেশ ও বিনিয়োগ
'এমপাওয়ারিং ইনোভেশন কানেক্টিং অপরচ্যুনিটি' শিরোনামে সেশনের মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশে মোবাইল ডেটার উচ্চ ব্যয়ের সমস্যাটি তুলে ধরেন কনস্টেলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তানভীর আলী। তিনি জানান, বাংলাদেশে এটি মাসিক আয়ের প্রায় ২.৪ শতাংশ, অথচ প্রতিবেশী ভারতে তা মাত্র শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ।
তানভীর বলেন, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে উদ্ভাবনী এবং স্টার্ট-আপ উদ্যোগের চাহিদা রয়েছে। তবে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এই খাতে বিনিয়োগ এখনও কম।
তবে দেশের জিডিপির তুলনায় নবউদ্যোগ বা স্টার্টআপে বিনিয়োগ কম হলেও— স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে তিনি জানান, বর্তমানে ১,২০০ এর বেশি স্টার্টআপ রয়েছে বাংলাদেশে— গত এক দশকে যা দশগুণ বেড়েছে।
বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে, এবং বিভিন্নখাতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে বলেও জানান তিনি।