কর বোঝা কমাবে এনবিআর: ভবিষ্যতের মুনাফার সাথে সমন্বয়যোগ্য হবে আগাম কর

ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী, টার্নওভারের উপর ন্যূনতম কর হিসেবে কর্তিত আগাম কর এর চেয়ে কম মুনাফা কিংবা লোকসান হলে পরবর্তী বছরগুলোর মুনাফার সঙ্গে সমন্বয়ের সুযোগ আসছে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে।
সম্প্রতি একাধিক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। আর গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রাক-বাজেটে সভায় তিনি রপ্তানিকারকদের বিষয়টি জানিয়েছেন।
বৈঠকের পর সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা চাই ব্যবসাবান্ধব একটা বাজেট দিতে। ট্যাক্স পলিসি এমনভাবে করা হবে যাতে ইনভেস্টমেন্ট বাড়ে, জিডিপি বাড়ে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।'
রপ্তানির ওপর ১ শতাংশ হারে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা উৎস কর সংগ্রহ করছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর ওপরেও শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত টার্নওভার ট্যাক্স প্রযোজ্য রয়েছে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এনবিআর এটা ফেরতও দেয় না, আবার সমন্বয়ও হয় না এবং এটি করের বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, যিনি বৃহস্পতিবারের সভায় উপস্থিত ছিলেন, সাংবাদিকদের বলেন, "এ ধরনের প্র্যাকটিস পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।"
সচিবালয়ে বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের এবিষয়ে জানান, আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার-ও এসময় উপস্থিত ছিলেন।
ব্যবসায়ী নেতারা জানান, এনবিআর চেয়ারম্যান তাদের আশ্বস্ত করেছে যে আগামী অর্থবছর থেকেই ন্যূনতম অগ্রিম করের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হবে।
বর্তমান ব্যবস্থার সমালোচনায় বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মোট রপ্তানির উপর ১ শতাংশ উৎসে কর হিসেবে কোনো কোম্পানির কাছ থেকে ১ কোটি টাকা নেওয়ার পর চূড়ান্ত রিটার্ন দাখিলের সময় যদি দেখা যায়, বাস্তবে ওই কোম্পানির কর দিতে হবে ২০ লাখ টাকা। তখন এনবিআর বাড়তি নেওয়া ৮০ লাখ টাকা আর ফেরত দেয় না। অথচ ওই কোম্পানির অন্যান্য বিভিন্ন হিসাবে যদি এনবিআর ১০ লাখ টাকা কর পাওয়া হয়, সেটিও কোম্পানিকে দিতে হয়। অর্থাৎ, কোম্পানিটির মোট কর দেওয়ার কথা ৩০ লাখ, কিন্তু দিতে হচ্ছে ১ কোটি ১০ লাখ। 'এবছর এসব জায়গায় কিছু পরিবর্তন আসতেছে বলে আমরা জেনেছি।'
স্বাগত জানিয়েছে এফআইসিসিআই
বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন– ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে সঠিক পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছে। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, যেকোন ব্যবসায়ে মুনাফা যেমন আছে, তেমনি লোকসানও হতে পারে। সেক্ষেত্রে করের সমন্বয় ব্যবসায়িক উদ্যোগকে স্বস্তি দেবে, যা এখন খুবই দরকার। তবে উদ্যোগ ভালো হলেও- আমলাতান্ত্রিক কারণে সমন্বয়ের সময় যাতে জটিলতা তৈরি না হয়। সেক্ষেত্রে এমন ভালো উদ্যোগ কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
সমন্বয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে এনবিআরের ট্যাক্স বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "বিষয়টি বাজেটে পরিস্কার করা হবে। তবে যদি কর্তিত করের চেয়ে বেশি কর আদায় হয়— ওই কর সরকারের কোষাগারে থাকবে। পরবর্তী যেকোন বছরে যদি উক্ত ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা করেন, কিংবা অন্য কোনও কারণে বেশি ট্যাক্স দায় আসে, তাহলে ওই টাকা থেকে তিনি সমন্বয় করতে পারবেন।"
বর্তমানে দেশের কোম্পানির টার্নওভারের উপর ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ, যেকোন ধরনের কোম্পানিকে তাদের টার্নওভারের ওপর ন্যূনতম শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এ ছাড়া মোবাইল ফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ২ শতাংশ, তামাক ও কার্বনেটেড বেভারেজ কোম্পানির উপর ৩ শতাংশ ন্যূনতম কর প্রযোজ্য রয়েছে।
অপব্যবহারের শঙ্কা
বাংলাদেশে কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেহেতু এখনো কমপ্লায়েন্সের প্রবণতা কম, ফলে এর নতুন ব্যবস্থাটির অপব্যবহারের আশঙ্কাও করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ।
এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম-ও এমনটি মনে করছেন। তিনি বলেন, "কোম্পানিগুলোর একটি অংশ মুনাফা হলেও লোকসান দেখানোর মত অপকৌশল করে এই সুবিধার মিসইউজও করতে পারে। এক্ষেত্রে এনবিআরের ট্যাক্স বিভাগকে কঠোর নজরদারির সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। কিন্তু এর জন্য ট্যাক্সের মূল নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। অর্থাৎ, আয় না হলে ট্যাক্স নেওয়া যাবে না।"
ব্যবসায়ীদের আরো যেসব দাবি
বৈঠকে কাস্টমসে এইচএস কোডের জটিলতা দূর করতে ৮ ডিজিটের বদলে ৬ ডিজিট পর্যন্ত আমলে নেওয়াসহ অন্যান্য কয়েকটি দাবিও তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য উৎসে কর চূড়ান্ত কর আদায় হিসেবে গণ্য করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ০.৫ শতাংশ হারে নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে বিকেএমইএ।
এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাবে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকঋণের সুদহার কমানো এবং স্থিতিশীল রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যসহ যাবতীয় শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর এবং ভ্যাট আইনের আওতায় আরোপিত আগাম কর বা এডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে হবে।
শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর কর্মকর্তাদেরকে কর ফাঁকি বের করতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এর ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হয়। অনেক সৎ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা কমানোর জন্য পুরস্কার প্রথা বাতিল করে, বিকল্প প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, আসছে বাজেটে কর ব্যবস্থা ডিজিটাল করতে হবে। কর্পোরেট কর অনলাইন করতে হবে। ইউনিফায়েড সিঙ্গেল ডিজিট ভ্যাট করতে হবে। গত ৩ বছর ধরে অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকায় ভালো ব্যবসায়ীরা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে! এর থেকে পরিত্রাণের জন্য ন্যূনতম ৬ মাস এর মোরাটোরিয়াম পিরিয়ড দিতে হবে ও সহজ শর্তে ঋণ পুনর্গঠন করার নির্দেশনা দিতে হবে।