জুলাই-জানুয়ারি সময়ে চলতি হিসাবের ঘাটতি ৮৭ শতাংশ কমেছে

আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো থাকায় দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের অন্যতম উপাদান কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবের ঘাটতি চলতি অর্থবছরে ৮৭ শতাংশ কমেছে।
আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি নেট ইনকাম যোগ করে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স বের করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি শেষে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৫২ মিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪.২৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কমেছে।
২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর শেষে দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস ছিল ৫৬ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫.৯৬ বিলিয়ন ডলার। গতবছরের এই সময় শেষে রেমিট্যান্স এসেছিল ১২.৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.০৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৩.৬ শতাংশ।
চলতি হিসাবের ব্যালেন্স ঘাটিতে গেলেও সেটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক কমেছে। মূলত রেমিট্যান্স বাড়ায় ও বাণীজ্য ঘাটতি কমে আসায় এখানে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আমরা দেখতে পেয়েছি। বাণীজ্য ঘাটতি যদি গত অর্থবছরের মতো বেশি থাকতো, তাহলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট আরও বড় হতো। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স যেন ভালো অবস্থায় থাকে, তাতে দেশের ফরেক্স রিজার্ভের ওপর চাপ কমে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আমদানি প্রবৃদ্ধির চাইতে দেশের রাপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময় শেষে রপ্তানি ও আমদানির মধ্যে পার্থক্য বা বাণিজ্য ঘাটতি ৯ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১.৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২.৯১ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আমদানি প্রায় ১.২২ বিলিয়ন ডলার বাড়ার তুলনায় রপ্তানি আয় প্রায় ২.৩৯ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যাওয়ায় ট্রেড ডেফিসিট কমাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "বাণিজ্য ঘাটতি কমা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো। তবে ক্যাপিটাল মেশিনারিজসহ অনেক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট রিলেটেড পণ্য আমদানি কমছে। এগুলোর একটা প্রতিফলন আমরা আমদানিতে দেখতে পাচ্ছি।"
"বিনিয়োগে আমরা বর্তমানে কোনো চাঞ্চল্য দেখতে পাচ্ছি না। ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাড়লে আমদানিও বাড়বে," যোগ করেন তিনি।
আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত বেড়ে ৮৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে
ওভারডিউ এক্সপোর্ট প্রসিডগুলো দেশে আসায় এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে এইড আসার কারণে ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অন্যতম উপাদান আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্তি বেড়ে ৮৫০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে দেশের ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস বা আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্তি ছিল ৮১ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে সারপ্লাস প্রায় ৭৬৯ মিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের অর্থবছরের ৯০০ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২৫২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। একইসঙ্গে নেট ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট অনেক কমে এসেছে। অর্থাৎ, আমাদের যেসব এক্সপোর্ট পেমেন্টগুলো বিদেশে আটকে ছিল, সেগুলো দেশে আসছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট ২.০৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২২৪ মিলিয়ন ডলারে চলে এসেছে। এছাড়া অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে মিডিয়াম ও লং টার্ম লোন ১৭.৪ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, "আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট কমিয়েছে। ফলে বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য দেশে বিনিয়োগ যে হারে কমিয়ে নিয়ে আসছিলেন, সে গতি কমেছে। তবে নতুন করে বিনিয়োগও সেভাবে আসছে না।"
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছে, প্রকৃত এফডিআই অনেক কম। যেসব এফডিআই আমরা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে দেখছি, তার বড় অংশই রিইনভেস্টেড আর্নিংস, অর্থাৎ আগে যেসব বিনিয়োগ এসেছিল, সেগুলোর আয় আবার বিনিয়োগ হয়েছে।
এক্সপোর্ট প্রসিড দেশে আসায় ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে অনিশ্চয়তা কমে আসায় রপ্তানিকারকরা আগের মতো বিদেশে ডলার ধরে রাখছেন না। এছাড়া গত সরকারের সময়ে রপ্তানি বাড়িয়ে দেখানোর কারণে ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট বেশি দেখাতো। সেগুলোর হিসাবায়ন ঠিক হওয়াও ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট কমার অন্যতম কারণ।
আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্তি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ভালো দেখাতে সহায়তা করলেও সেটি আদতে ভবিষ্যতের জন্য ঋণ তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান।
জুলাই-জানুয়ারিতে বৈদেশিক ঘাটতি ৭৫% কমেছে
জুলাই-অগাস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জের ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ, পরবর্তীতে বন্যা এবং গত সাত মাস ধরেই দেশজুড়ে নানা দাবিতে আন্দোলনের কারণে ম্যাক্রোইকনোমিক ইনস্টেবিলিটি থাকার পরও চলতি ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭মাসে দেশের এক্সটার্নাল ব্যালেন্স হিসেবে পরিচিত ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের সামগ্রিক ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৪ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ওভারঅল ব্যালেন্সের ডেফিসিট বা সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১.১৭ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় শেষে এই ঘাটতি ছিল ৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আগের অর্থবছরের তুলনায় ঘাটতি কমেছে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার।
ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেকাংশে কমে আসাকে সাধুবাদ জানিয়ে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "অভারঅল ডেফিসিট কমে আসা অবশ্যই আমাদের অর্থনীতির জন্য সুখবর। এর প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে দেশের ফরেক্স রিজার্ভ ও এক্সচেঞ্জ রেটে দেখতে পাচ্ছি।"
তবে, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ইন্ডিকেটরগুলো ভালো হলেও এরোর অ্যান্ড অমিশন বেড়ে যাওয়াকে নেতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। এটি কম হলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের কোনো ঘাটতি থাকতো না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এরোর অ্যান্ড অমিশনের নেতিবাচক ব্যালেন্স এর অর্থ হলো, 'আনরেকোর্ডেড আউটফ্লো'। অর্থাৎ, রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ হয়ে গেছে, তবে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ঘাটতি থেকে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ এরোর অ্যান্ড অমিশনের নেগেটিভ ব্যালেন্স ১.৭ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এটি ১৬১ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি শেষে এই নেগেটিভ ব্যালেন্স ছিল ৬৫০ মিলিয়ন ডলার।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "বর্তমানে হুন্ডির চাহিদা অনেক কমে আসায় এরোর অ্যান্ড অমিশনের পুরোটা ক্যাপিটাল ফ্লাইট, এমন বলা যাবে না। তবে, এটাকে আরও খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে, এর বাড়তি প্রবণতার দিকে আমাদের আলাদা করে নজর দিতে হবে।"