সরকার পরিচালনার ব্যয় বাড়ছে, টান পড়ছে এডিপিতে

প্রতিবছরেই বাড়ছে সরকারের পরিচালন ব্যয়। গত ছয় অর্থবছরের বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে, যেখানে বছর বছর বেড়েছে পরিচালনখাতে বরাদ্দ। এতে টান পড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দেও।
আগামী অর্থবছরের বাজেটও এমন সীমাবদ্ধতার চাপ রয়েছে, যেখানে রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ পরিচালনখাতে বরাদ্দ রাখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য তহবিল কম পাওয়া যাচ্ছে।
বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি, ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং সরকারিখাতের.বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কারণে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। যেকারণে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন ঋণ-নির্ভর রেখেই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
ব্যাপক এই পরিচালন ব্যয়ের চাপ সামলাতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং প্রাক্কলিত বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দের তুলনায় পরিচালনখাতে বরাদ্দ ১১৪ শতাংশ বেশি রাখছে— যা ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধান বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আগের সরকারের রেখে যাওয়া আর্থিক বোঝা— এই ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনামলে জ্বালানিখাতে লাগামহীন হারে ভর্তুকি প্রদান, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিপুল ঋণ নেওয়া, এবং আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিকে পরিণত করা হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ২৩ শতাংশ ব্যয় হয় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনে। এছাড়া, ২২ শতাংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধ, এবং ২০ শতাংশ ব্যয় হয় ভর্তুকি ও প্রণোদনায়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট, চলতি অর্থবছরের বাজটের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি, যেখানে পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দের আকার ৫ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা (৬৮ শতাংশ) বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হয়েছে ২.৭০ লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২.৬৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা। তবে গত এক দশকের বাজেট বিশ্লেষণে সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে ১২৪ শতাংশ বেশি ছিল। পরের অর্থবছরগুলোতে এই ব্যবধান কমতে শুরু করে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই ব্যবধান বাড়ছে। চলতি অর্থবছর এটি বেড়ে ৯১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের সরকার রাজস্ব আয়ের পুরোটা ব্যয় করেছে পরিচালন ব্যয়ে। যার ফলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পুরোটাই ঋণ-নির্ভর রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ''এসব ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হলে— অর্থনীতি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখতো। স্কুল-কলেজে শিক্ষা উপকরণের সংকট রয়েছে, শিক্ষকের বেতনও এ দেশে অনেক কম। একজন সরকারি প্রাইমারি শিক্ষকের চেয়েও ঢাকার একটি প্রাইভেট কার চালকের বেতন অনেক বেশি। মফস্বলে অনেক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা ও ওষুধ পাওয়া যায় না। পরিচালন ব্যয়ে সরকারের অপচয় নিয়ন্ত্রণ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত।''
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "ভর্তুকি কমানোর কথা যত সহজে বলা যায়, ততো সহজে কমানো যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে সারসহ কৃষি উপকরণের দাম না কমলে কৃষি ভর্তুকি কমানো সম্ভব হবে না। কারণ, এর সঙ্গে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। তবে বিদ্যুতের কস্ট (ব্যয়) কমানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে।"
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ ধরা হচ্ছে।
আসন্ন বাজেটই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত প্রথম বাজেট। চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তবে গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তাদের পতন হলে– অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।
পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগের অর্থবছর থেকেই ব্যবসায়ীদের খুশী রাখতে নানা প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে ভর্তুকি-নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলে আওয়ামী লীগের সরকার। ২০১৫ সালে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিভিন্ন ভাতার প্রচলন করে বেতন-ভাতা ও পেনশনের আকার বাড়ানো হয়েছে।
এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের ঝুঁকি ভাতাসহ বিভিন্ন নামে নতুন নতুন ভাতা চালু করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ চালু করে শেখ হাসিনা সরকার, যা এখনও বহাল আছে।
বাড়তি পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি দ্রুত উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে উচ্চসুদে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার, যার সুদ পরিশোধ করতেই চলতি বাজেটে ৯৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি প্রায় এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আগের সরকারের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেন, অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপের চাপে আগের সরকার নানা রকম ভর্তুকি, প্রণোদনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
''শ্রম আইন অনুযায়ী, সকল খাতের শ্রমিকদের জন্য বছর শেষে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের বিধান করলেও সরকারি চাকরিজীবীরা অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ পাচ্ছে, যা পাবলিক মানি খরচ করে বৈষম্য সৃষ্টি করছে''- জানান তিনি।
পরিচালন ব্যয় কমাতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ব্যয় সাশ্রয়ী ই-সার্ভিস চালু করাসহ মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে।
কমিশন উল্লেখ করেছে যে, কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযৌক্তিকভাবে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। একই বিষয়ে একাধিক মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এর ফলে একদিকে সরকারের ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে জনপ্রশাসনের কাজের মাত্রা ও দক্ষতাও কমেছে।
চলতি অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলোর মোট লোকসান ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে বলে বাজেট নথিতে পূর্বাভাস দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের ওপর বোঝাস্বরূপ রয়ে গেছে উল্লেখ করে সংস্কার কমিশন বলেছে, বিপুল ভর্তুকি দিয়ে এগুলোকে এখন টানতে হচ্ছে সরকারকে।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা
বড় অংকের পরিচালন বাজেটের বরাদ্দ দিতে গিয়ে, প্রস্তাবিত বাজেটে ৫ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করছে অর্থবিভাগ, যা জিডিপির ৯.৩ শতাংশ।
এরমধ্যে এনবিআর আওতাধীন করব্যবস্থা থেকে ৫ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্মাত্রা ধরা হচ্ছে, যা জিডিপির ৮.২ শতাংশ। যদিও রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষমাত্রা অর্জনযোগ্য নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "নতুন অর্থবছরের বাজেটে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলে তা অর্জনযোগ্য হবে না। কারণ, সরকার রাজস্বখাতে এমন কোনও সংস্কার করেনি যে, ২০ শতাংশ বা তার বেশি রাজস্ব বাড়বে। তাই সরকার নতুন বছরের জন্য যে ব্যয় প্রাক্কলন করেছে, তা-ও খুবই উচ্চাভিলাষী বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, দায়িত্ব ত্যাগের আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের মেয়াদে কোন কোন সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে চায়, আগামী বাজেটে তা পরিস্কার করতে হবে।
যদিও অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নতুন অর্থবছরে আয়কর এবং ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ওপর জোর দেবে সরকার। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে আয়কর এবং ভ্যাট বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হবে নতুন বাজেটে।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, আর নতুন অর্থবছরের বাজেটে তা প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.২ শতাংশ।
এই ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কমা ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রধান প্রধান সংস্কার উদ্যোগগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করছে অর্থমন্ত্রণালয়।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আসন্ন বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উদ্যোগ নিয়েছেন, যার ফলে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার আশা করছেন তাঁরা। যুদ্ধ বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম কমবে, এতে বাংলাদেশের বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমবে বলে তাঁরা মনে করেন।
অর্থবিভাগ আগামী অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের পুনরুদ্ধারের ফলে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার প্রত্যাশা করছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬.৭৫ শতাংশ, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৫.২৫ শতাংশ করা হয়।
নতুন বাজেটে নারী ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ গুরুত্ব থাকবে বলে জানান কর্মকর্তারা।