রহস্যময় ফইট্টা; কথায় আছে, দেখায় নেই!

ছোটবেলায় আমার প্রবল আগ্রহের বস্তু ছিল বারান্দার এক কোণে পড়ে থাকা শূন্য একটি খাঁচা। কাঠের ফ্রেমে লোহার শিক দিয়ে তৈরি টিনের ছাদ দেওয়া সেই খাঁচাটা সবার কাছে ফইট্টার খাঁচা নামে পরিচিত ছিল। বাবা প্রায়ই গজারি বনে শিকারে যেতেন। ভাওয়ালের গজারি বন তখন চিতাবাঘ, মায়া হরিণ, বন্য শূকর, অজগর, ময়ূরসহ নানা জাতের বন্য প্রাণীতে সমৃদ্ধ ছিল।
একবার শিকারে গিয়ে তিনি একটি ফইট্টার বাচ্চা সংগ্রহ করে আনেন। সুন্দর একটি খাঁচা তৈরি করে তিনি প্রাণীটাকে কয়েক বছর ধরে লালন-পালন করেন।
কিন্তু সেই ফইট্টার বিয়োগগাথা বেশ মর্মান্তিক। একবার খাঁচা পরিষ্কারের সময় বাবা তার আদরের ফইট্টাটিকে বাইরে বের করে রেখেছিলেন। তখন তারই পোষা একটি কুকুর এসে ফইট্টাটিকে আক্রমণ করে। আর প্রায় সাথে সাথেই সেটা মৃত্যুবরণ করে। বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তিনি ঘর থেকে বন্দুক এনে সোজা কুকুরটার মাথায় গুলি করেন।
এর পর থেকে তাকে আর কোনো প্রাণী পুষতে দেখা যায়নি। আসলে বন্য কিংবা পোষা সব কুকুরই ফইট্টার প্রধান শত্রু।

বাবাকে সেই ফইট্টার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, 'ওটা ছিল খুরওয়ালা খরগোশ।' তখন আমার মাথায় কেবলই ফইট্টার চিন্তা ঘুরপাক খেত। ভাবতাম বড় হয়ে আমিও গজারি বনে শিকারে যাব, এরপর একটা ফইট্টার বাচ্চা সংগ্রহ করে নিয়ে পুষব।
এখন কথা হচ্ছে, কে এই ফইট্টা? কী তার পরিচয়? এই খুরওয়ালা খরগোশ শুধু গজারি বন নয়, সারা দেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই দেখা যেত। সুস্বাদু মাংসের লোভে বন্দুকধারী শিকারিদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ওদের ফাঁদ পেতে ধরত, কখনো দলবেঁধে ধাওয়া দিয়ে বন্দী করত।
এটার সম্পর্কে আমি বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ফইট্টা দেখেছে, ফইট্টা ধরেছে, ফইট্টা খেয়েছে—এমন বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু ফইট্টার দেখা পাইনি।
অনেকের ধারণা, এরা আসলে খরগোশ নয়, এ দেশে বসবাসকারী সবচেয়ে ছোট জাতের হরিণ।

খ্যাতিমান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা খান তার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী' (তৃতীয় খণ্ড) বইয়ে একে মালায়ান মাউস ডিয়ার বলে ধারণা করেছেন। তিনিও দীর্ঘ সময় ধরে ফইট্টার খোঁজে চষে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। কিন্তু সরাসরি কখনো এদের দেখা পাননি।
সর্বশেষ ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ফইট্টার অবস্থানের সংবাদ পাওয়া গেছে; মধুপুর শালবনে। তবে ধারণা করা হয়, কোনো বিশেষ অঞ্চলে অতি সংগোপনে এখনো এরা টিকে রয়েছে।