মন্দা এলে আমাদের কী হবে?

জার্মানি-প্রবাসী বন্ধু মাহমুদ মনির সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক। চাল সংকটের কারণে এখন সেখানে একসঙ্গে একজন ক্রেতা দুই কেজির বেশি চাল কিনতে পারছেন না। কয়েকদিন আগে তিনি ও তার স্ত্রী সুপারশপে গিয়েছিলেন চাল কিনতে। কিন্তু দুজনই যেহেতু ব্যস্ত এবং ছুটির দিন ছাড়া দোকানে গিয়ে চাল কেনা সম্ভব নয়; যেহেতু ওখানে বাংলাদেশের মতো পাড়া-মহল্লায় চালের দোকান নেই এবং বাঙালি বলে ভাত না খেলে চলেও না, তাই তারা ভাবলেন, একসঙ্গে অন্তত চার কেজি চাল কেনা গেলে ৮-১০ দিন চলবে। তাই কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী সুপার শপে আলাদা লাইনে দুই কেজি করে চাল কিনে চার কেজি চাল নিয়ে বাসায় যান। মাহমুদ মনির ভাষ্য, চালের দাম বেড়ে গেছে বলে তারা যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত কারণ বাজারে চাল নেই।
অর্থনীতির ভাষায় যা মন্দা, সাধারণ মানুষের কাছে সেটি অভাব।
অভাব হতে পারে প্রধানত দুরকম:
১. আপনার পকেটে টাকা আছে, কিন্তু বাজারে গিয়ে পণ্য পেলেন না। কারণ পণ্যের উৎপাদন বা সরবরাহ নেই। তখন এই অভাব ধনী-গরিব সবাইকে স্পর্শ করে।
২. বাজারে পণ্য আছে, কিন্তু আপনার পকেটে কেনার মতো টাকা নেই। এই অভাব শুধু গরিবদের স্পর্শ করে।
টাকা থাকার পরেও পণ্য কিনতে না পারার পেছনে প্রধানত দায়ী পণ্যের সরবরাহ থাকা, অর্থাৎ বাজারব্যবস্থার ত্রুটি। অনেক সময় এমনও হয় যে, গুদামে পণ্য আছে কিন্তু বাজারে নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা আরও বেশি দামে বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট সময় মালামাল গুদামজাত করে রাখেন।
অভাব তৈরির পেছনে অনেক সময় কিছু ক্ষমতাবান মানুষের খামখেয়ালি, ইগো, মাস্তানি এবং মুনাফার মানসিকতাও বড় ভূমিকা পালন করে। যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে ইউক্রেন থেকে গম বিশ্বের কোনো দেশে রপ্তানি হচ্ছে না। ফলে যেসব দেশ ইউক্রেনের গমের উপর নির্ভরশীল সেসব দেশে গমের সংকট। গমের সংকট মানে আটার সংকট। আটার সংকট মানে- রুটি বিস্কুটসহ এ জাতীয় খাবারের সংকট। যেসব দেশের মানুষ প্রধানত এই গমের তৈরি খাদ্যের উপরে নির্ভরশীল, তাদের পকেটে টাকা আছে, গমও ইউক্রেনের গুদামে আছে। কিন্তু মানুষ সেটা খেতে পারছে না। এটা হচ্ছে অভাবের তৃতীয় ধরন—যার জন্য দায়ী মূলত কিছু অবিবেচক ও যুদ্ধবাজ মানুষ। আবার বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের ব্যবসা, প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি করে একসঙ্গে বিশাল মুনাফা তুলে নেয়ার মতো ঘটনাও অনেক সময় অভাবকে ত্বরান্বিত করে।
কেন এত কথা? কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রভাবে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্বব্যাংক প্রধান ডেভিড ম্যালপাস। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চীনে নতুন করে একের পর এক লকডাউন ঘোষণাও অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক বাণিজ্যিক আয়োজনে ম্যালপাস বলেন, 'বৈশ্বিক জিডিপির বর্তমান যে অবস্থা, তাতে এই মন্দা এড়ানোর পথ খুঁজে বের করাটা কষ্টকর হবে।'
প্রশ্ন হলো, যদি শিগগিরই বা অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা আসে, বাংলাদেশে তার অভিঘাত কী হবে এবং দেশের মানুষ সেটা কী করে ঠেকাবে? বিশেষ করে স্বল্প আয়ের এবং প্রান্তিক মানুষেরা কী করে ওই পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকবেন? কোনোমতে ওই যাত্রা টিকে গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের শরীর ও মনে কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে এখনই বলা দরকার, চিন্তা করা দরকার এবং সত্যিই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে- কীভাবে এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো যাবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা দরকার। এনিয়ে এখনই কথা বলা দরকার, যাতে বিশ্বে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলেও বাংলাদেশ এর অভিঘাত যতটা সম্ভব ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে পারে।
আশার সংবাদ হলো, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্যগুলো আমদানি-নির্ভর নয়। যেমন চাল, আলু, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম বাংলাদেশের মানুষই উৎপাদন করেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, যার কাঁচামাল ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের ৫০ বছরে সত্যিই যদি কোথাও বিপ্লব হয়ে থাকে, সেটি কৃষি খাতে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরাই আমাদের প্রধান নায়ক। কৃষকরাই আমাদের প্রধান ভরসা। কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন, বিশেষ করে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন কৃষির চিত্র বদলে দিয়েছে। সেইসঙ্গে কৃষির আধুনিকায়ন; বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও তরুণ প্রজন্মের বিরাট অংশের মানুষের আধুনিক কৃষিতে যুক্ত হওয়া এবং সর্বোপরি কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। সরকারের কৃষি অনুকূলনীতি ও প্রণোদনাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। মৎস্য ও পোল্ট্রি শিল্পেও বিারট বিপ্লব হয়েছে। ফলে এখন সামান্য আয়ের মানুষের পাতেও মাছ, মাংস ও ডিম পড়ছে।
বিশ্বে এখন সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। ভাতের পরেই প্রধান খাদ্য আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ এবং মিঠাপানির মাছে তৃতীয়। তাছাড়া, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। অনেক জমিতেই বছরে তিনটি ফসল হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি।
তার মানে বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র এই দেশের কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিজসম্পদ। প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর মধ্যে শুধু গম ও তেলই বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। কিন্তু যদি অর্থনৈতিক মন্দা বা সারা বিশ্বে খাদ্যের সংকটও দেখা দেয়, তাহলেও অন্তত ভাত, সবজি ও মাছের সংকট হওয়ার কথা নয়। তখন সমস্যা দেখা দেবে স্বল্প আয়ের এবং প্রান্তিক মানুষের। অর্থাৎ, মানুষের পকেটে যদি টাকা না থাকে বা নিত্যপণ্যের দাম যদি অতিমাত্রায় বেড়ে যায়, তখন এই স্বল্প আয়ের মানুষেরা বাজারে পণ্য থাকার পরেও কিনতে পারবেন না।
আবার স্বল্প আয়ের মানুষ হয়তো কষ্ট করে হলেও ভাত ও সবজি খেতে পারবে। কিন্তু মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের মতো পণ্য যদি খেতে না পারে; যদি এসব প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার তাদের ক্রয়সীমার নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে একটা বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পড়বে দেশ। কারণ বিরাট জনগোষ্ঠীর শরীরে প্রোটিন বা পুষ্টির অভাব দেখা দেবে। তাদের কর্মক্ষমতা কমতে থাকবে। তারা কাঙ্ক্ষিত সময়ের আগেই বৃদ্ধ হয়ে যাবেন এবং নানাবিধ স্বাস্থ্যসমস্যায় পড়ে সরকারি হাসপাতালগুলোয় ভিড় বাড়াবেন। তাদের চিকিৎসার পেছনে রাষ্ট্রকে অনেক পয়সা খরচ করতে হবে। তার মানে সত্যিই মন্দা এলে এবং তার ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে তার প্রধান অভিঘাতটা আসবে স্বল্প আয়ের এবং প্রান্তিক মানুষের উপরে—যারা মূলত দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক জটিলতায় পড়ার ঝুঁকিতে পড়বেন।
তাহলে করণীয় কী?
১. নিত্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। চালের পর্যাপ্ত উৎপাদন এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে সরকারি গুদামে চালের মজুত বাড়াতে হবে। বাজারে সরবরাহ ও দাম ঠিক রেখে বেসরকারি পর্যায়েও চাল সংরক্ষণ করতে হবে। তবে এই সংরক্ষণ যাতে কোনোভাবেই অসৎ উদ্দেশ্যে না হয়, অর্থাৎ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যাতে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
২. কোনো জমি ফেলে রাখা যাবে না। যে জমি যে ধরনের ফসল আবাদের উপযোগী, সেখানে সেই ধরনের ফসল আবাদে জমির মালিককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মালিক নিজে আবাদ করতে না পারলে বা না চাইলে সহজ শর্তে জমি বর্গা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
৩. দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়, এমন খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, যেমন আলু।
৪. দেশের সবগুলো সরকারি-বেসরকারি কোল্ড স্টোরেজ বা সংরক্ষণাগারে পণ্য মজুত করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মজুত করতে গিয়ে যাতে বাজারে সরবরাহ কমে না যায়। মজুত করতে হবে মূলত উদ্বৃত্ত পণ্য।
৫. মানুষকে সাশ্রয়ী হতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে টাকা জমানো কঠিন। কিন্তু স্বচ্ছল মানুষেরাও যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যপণ্য কেনা বন্ধ করেন, তাহলে বাজারে কোনো পণ্যের দাম হুট করে বাড়বে না। ন্যূনতম ক্রয়, ন্যূনতম খাওয়া—এই নীতিতে যেতে হবে স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল সবাইকে। যাতে অর্থ বা পণ্যের সংকট দেখা দিলেও মানুষ কম খেয়েও দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। সেই অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৬. নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। অন্তত মৌলিক খাদ্যপণ্যগুলোর দাম এমন স্তরে রাখতে হবে যাতে রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তিও তার খাদ্য নিশ্চিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। আবার মনিটরিংয়ের নামে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাতে আতংক ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
৭. মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা করোনার অতিমারি আমাদের দিয়েছে, সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। আমার ঘরে ৫০ কেজি চালের বস্তা থাকা অবস্থায় পাশের ঘরের লোক ভাত না খেয়ে থাকবে—এমন অমানবিকতার চর্চা আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশের মানুষ এইসব ইস্যুতে যথেষ্ট মানবিক। সেই মানবিক শক্তিটাই যেকোনো দুর্দিনে মানুষকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
- লেখক: আমীন আল রশীদ নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর