স্যানিটারি ন্যাপকিন ইস্যু ও বাংলা একাডেমি

বাংলা একাডেমির বইমেলায় তোপের মুখে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি বন্ধ সংক্রান্ত খবরটি দেখার পর মনে হলো, 'মাসিক' বা 'ঋতুকাল' এবং এর সাথে জড়িত স্যানিটারি ন্যাপকিন এখনো একটি অপবিত্র ও নিষিদ্ধ বিষয়ই রয়ে গেছে এই সমাজে। তবে আরো ইন্টারেস্টিং লেগেছে যখন দেখলাম তীব্র সমালোচনার মুখে বাংলা একাডেমি বইমেলায় বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত জরুরি একটা ইস্যু নিয়ে কে বা কারা হইচই করলো, আর কর্তৃপক্ষ কেন তাদের খুশি করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো? যদিও পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রসার ও ব্যবহার সম্পর্কে বাংলা একাডেমির কোনো প্রকার সংকোচ নেই এবং ওয়াশরুমের পাশে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখা হবে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।
বাংলা একাডেমি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা হচ্ছে যে বইমেলার স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রির ব্যাপারটি স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে অন্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কিছু নীতি লঙ্ঘন করেছে বলে একাডেমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের কথা হচ্ছে, যদি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কিছু নীতি লঙ্ঘন যদি করেই থাকে, তাহলে তো একাডেমি কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল প্রথমেই তাদের শক্ত হাতে ধরা। তা না করে তারা চুপ করে থাকলো এবং যখন কেউ কেউ স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন, তখন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে উঠলো।
বইমেলায় 'নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্যানিটারি ন্যাপকিন' বিক্রির ব্যবস্থা কেন থাকবে, এ নিয়েও একটা পক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন। তারা এর সাথে গরু-ছাগল বা চাল-ডাল বিক্রির কথাও বলছেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন মেলায় বিক্রি হলে এইসব পণ্য কেন মেলায় বিক্রি হবে না? যাদের কাছে চাল-ডাল-মাংস আর স্যানিটারি ন্যাপকিন এক জিনিস, তাদের কথার উত্তর দেয়ারও প্রয়োজনবোধ করছি না।
অন্য আরেকটা পক্ষ মনেকরছেন এই ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন সরকার বিরোধীরা। কারণ এই মানুষগুলোতো এর আগে পুরুষের দাঁড়িয়ে পেশাব করা ও যেকোন অনুষ্ঠান স্থলে টয়লেট থাকা-না থাকা নিয়ে আওয়াজ তুলেননি, তাহলে এখন কেন কথা বলছেন? এই হইচই ও হাসাহাসি করাটাকে এনারা অন্যভাবে বিপ্লবের বিরোধিতা করা বুঝিয়েছেন। যদিও দরকার নাই উত্তর দেয়ার, তাও জানাতে চাই, রাস্তায় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থলে টয়লেটের ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্নজন দাবি জানিয়েছেন, লিখেছেন। প্রকাশ্যে পুরুষের দাঁড়িয়ে পেশাব করা নিয়েও সমালোচনা করেছেন। এইসব আলোচনা ও সমালোচনার পর সিটি কর্পোরেশন ও দু-একটি এনজিও টয়লেট স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিল। যাক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
বাংলা একাডেমি স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রয়কারী দুটি স্টল বন্ধ করে দেয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন তীব্র সমালোচনা শুরু হয়, তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নারী সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমও বাংলা একাডেমির পরিচালককে মেনশন দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। এমনকি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, যা হয়েছে তা উচিত হয়নি। একই সঙ্গে তিনি ক্ষোভও জানিয়েছেন। ফারুকী নিশ্চিত করেছেন, সোমবার থেকে বইমেলায় আবারও স্যানিটারি ন্যাপকিন থাকবে। স্ট্যাটাসে ফারুকী লিখেছেন, 'স্যানিটারি ন্যাপকিন খুবই স্বাভাবিক একটা জিনিস। সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে উইমেন হেলথ হাইজিন নিয়ে সারা দেশে সচেতনতা তৈরি করেছে এবং করছে সেখানে যেকোনো কারণেই হোক বই মেলায় এটাকে নিয়ে এই আলোচনাটা যে হইতে হলো, এটা আমাদের জন্য বেদনার।' যাক, আমাদের সমালোচনা করার পক্ষে সরকারের সমর্থনও পাওয়া গেল।
এ কথা সত্যি যে পিরিয়ড, অর্থাৎ মাসিক বা ঋতুকালীন সময়টা এখনো আমাদের সমাজে ট্যাবু। এটি অপবিত্র ও নিষিদ্ধ একটি বিষয়। তবে বহু বছরের চেষ্টার পর এ-সংক্রান্ত প্রাচীন ধারণা থেকে আমরা অনেকটাই বের হয়ে আসতে পেরেছি বলে মনে করছি। হঠাৎ বইমেলায় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত আমাদের কিছুটা উদ্বিগ্ন করে তুললো। দশ বছর আগেও মেয়েদের জীবনে এই সময়টা ছিল কষ্ট, আতংক ও লজ্জার। বাইরে যাওয়া, খেলাধুলা করা, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, স্কুলে যাওয়া সবকিছুই ছিল চ্যালেঞ্জিং। সবচেয়ে বড় কথা এই স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন ও এর গুরুত্ব নিয়ে অধিকাংশ মেয়ের সাথে পরিবারের কেউ খোলাখুলি কথা বলে না ও পরামর্শ দেয় না।
এদেশের অধিকাংশ বাল্যবধু এখনো ঋতুকাল সম্পর্কে ঠিকমতো জানে না। জানে না এই সময়টায় তার কী করা দরকার, স্বামী সহবাস করা যাবে কি না, তাকে কতটা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শুধু পিরিয়ড কেন, তার দেহের আরো অন্যান্য পরিবর্তন নিয়েও তাদের কোনো ধারণা থাকে না। গ্রামের অনেক পরিবারেই এখনো মাসিক হলে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে হয় এবং সন্ধ্যা নামার পর গোপনে ধুয়ে বাড়ির পেছনে মেলে দিতে হয়। এই সময়টাতে মেয়েদের কী করা দরকার. কতটা পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, কী খেতে হয়, এসব নিয়ে গত কয়েক বছর যাবত প্রচারণা চলছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। কাজেই বইমেলা থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই প্রডাক্টটি সরিয়ে নেবার দাবি ছিল অবান্তর।
অনেক মা ও মেয়ে মাসিক চলাকালে নিজেকে অপবিত্র ভাবেন, সমাজ তাকে এমনটাই ধারণা দেয়। মাত্র ২-৩ বছর আগে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সালমার (ছদ্মনাম) যখন মাসিক শুরু হলো, তখন তাকে প্যাডের পরিবর্তে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে দেয়া হতো, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। সংসারের বাজারের হিসাবের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনাটা ছিল বাড়তি ব্যয়। সালমার মা, দুই বোন সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য, সেই পুরানো কাপড় বারবার ধুয়ে ব্যবহার করতে হয়। দেশে যখন স্যানেটারি ন্যাপকিনের দাম বাড়ানো হলো, তখন অনেকেই বয়ঃসন্ধিকালের এই পরিচর্যার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।
সালমারা কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়, এরা আমাদের বন্ধু, বোন কিম্বা আমরাই। এদের অধিকাংশ নারী কোনোদিনও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং যৌনজীবন নিয়ে কোনো তথ্য পাননি। জানতে পারেননি এই মাসিকের সাথে নারীর স্বাস্থ্য, প্রজনন, গর্ভধারণ কতটা সম্পর্কিত। তাদের স্কুল, পরিবার বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্পষ্টভাবে তেমন কোনো তথ্য দেয়া হয় না।
সর্বোপরি কিশোরীর জন্য এইসময় যথেষ্ট প্রোটিন দরকার হয়, পরিচ্ছন্ন থাকতে হয় এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম সব চালিয়ে যাওয়া যায়—এই তথ্য না পাওয়া শিশু-কিশোরীর সংখ্যাও দেশে অনেক। অথচ সবচেয়ে সত্য কথা হলো, একজন শিশু যখন তার বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছে, তখন তার ভেতরে মনো-দৈহিক, সামাজিক এবং আবেগজনিত অনেক প্রশ্ন দেখা দেয় বা সমস্যা তৈরি হয়। এ সময় নিজের দেহ ও মনের এমন সব পরিবর্তন সে লক্ষ করে, যা সম্পর্কে সে জানে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে যে ১০ থেকে ১৯ পর্যন্ত কৈশোরকাল এবং এটাই বয়ঃসন্ধিকাল। বাংলাদেশে মোট ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ কিশোর-কিশোরী। (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৮)। আইসিডিডিআরবি বলছে, বয়ঃসন্ধিকালের শিশুরা বাবা-মা অথবা তাদের শিক্ষকদের সাথে নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো কথাই বলে না। অন্যদিকে অভিভাবকরাও বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করেন না। সেই গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এই ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে থাকা শিশুরা এমন একটা সমাজে বা গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করে, যারা সনাতনী ধ্যানধারণা বিশ্বাস করে ও চর্চা করে। এরা কোনোভাবেই কিশোর-কিশোরীদের সাথে যৌন জীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো আলোচনাকে গ্রহণ করেন না।
বরং এই বিষয়ক আলোচনাকে ঘরে-বাইরে, এলাকায়, স্কুলে এখনো ভয়াবহভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কতগুলো খুব জরুরি বিষয় সবার জানা দরকার, যেমন—মাসিক, মাসিককালীন পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্যতত্ত্ব, যৌনতা, পরিবার পরিকল্পনা এবং যৌনবাহিত রোগ। এইসব নিয়ে আলোচনা করাটা বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে গর্হিত কাজ বা সামাজিক ট্যাবু। এরই একটা চিত্র আমরা দেখতে পেলাম বইমেলায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও দেশে বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারছি না। বাংলাদেশে শতকরা ৫৯টি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তাদের ১৮ বছরের আগেই। শতকরা ২২ জনের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে (তথ্যসূত্র: ইউনিসেফ)। সেখানে মেয়েশিশুরা তাদের ঋতুকালীন সময়, এর বিভিন্ন দিক, প্রজনন স্বাস্থ্য ও যৌনজীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়েই বয়স্ক স্বামীর সহবাসের সঙ্গী হতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল এবং এর সাথে জড়িত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাগুলো নিয়ে সেভাবে কোনো আলোচনা হয় না কোথাও। বিশেষ করে মেয়েদের মাসিক হলে কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, কী কী খেতে হয়, কীভাবে ভয় দূর করা যায়, শরীরে ও মনে অস্বস্তি হলে কী করতে হবে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেয়েদের দেয়া হয় না। শুধু একটা কথাই জানানো হয়: এ সময়টায় একটি মেয়ে "অপবিত্র" হয়ে যায়। দেশে বয়ঃসন্ধিকাল-বান্ধব তেমন কোনো সার্ভিসও নাই। এই বয়সীদের জন্য কার্যকর স্বাস্থ্য চিন্তা কী হতে পারে, এ নিয়ে আলাদাভাবে কিছু ভাবা হয়নি।
আমাদের দরকার কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা। এদেশে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা, সামাজিক মতমোড়লরা এই ইস্যুটি নিয়ে তেমনভাবে সচেতন নন। প্রচারণা বাড়িয়ে সবাইকে জানাতে ও বুঝাতে হবে 'মাসিক' কোনো স্ত্রীরোগ নয়, এটি লজ্জাজনক, অপবিত্র, অচ্ছুৎ বা নিষিদ্ধ কোন বিষয় নয়। মাতৃত্বের জন্যই এই প্রক্রিয়া জরুরি। বইমেলার মতো বিভিন্ন জায়গায় যখন এই ইস্যুটি নিয়ে খোলাখুলিভাবে বেশি বেশি আলোচনা হবে ও সুলভে বা বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা হবে, তখন এর ব্যবহার বাড়বে। মনে রাখতে হবে যে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে নারীর স্বাস্থ্য চিন্তা এখনো সেকেন্ডারি।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।