মাখোঁর বাংলাদেশ সফর: আমাদের মুগ্ধতার ঘোর কাটে না!

বাঙালির মুগ্ধতার কোন শেষ নেই! গত ১০ তারিখ প্রায় দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। মাখোঁর এই প্রথম বাংলাদেশে আসা। মাখোঁ দ্বিতীয় ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফর করলেন। প্রায় ৩৩ বছর পর কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এলেন।
প্রায় ২৩৩ বছর আগে হয়ে যাওয়া ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীতে প্রথম রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্কের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা হয় যা পৃথিবীতে ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার জন্ম দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার জন্ম হওয়ার ফলে ফরাসি জাতিটি একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে যায় পৃথিবীর সব শ্রেণির শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর কাছে।। ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়টিকে মাথায় রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম সংশোধনী সংযোজিত করেছিল। তাদের সংবিধানে সংশোধনীটি ছিল মার্কিন কংগ্রেস ধর্ম নিয়ে কোনো আইন করতে পারবে না।
সেই ফরাসি বিপ্লবের সময়কাল থেকে নানা দেশের শিল্প-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী মহলে ফ্রান্সের প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। ফরাসিরা নিজ দেশের শিল্প-সাহিত্যের বিষয়ে যে মননশীলতা সৃষ্টি করেছে, তার পাশাপাশি তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর প্রতি বর্ণবাদী চরম লুন্ঠনের মর্মান্তিকতা আজও পৃথিবী গভীরভাবে লক্ষ করে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উপনিবেশ শক্তি ছিল ব্রিটিশরা। তারপরেই ফরাসিরা। এই দুটি দেশের উপনিবেশগুলোর দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাই ফরাসিদের উপনিবেশ ত্যাগ করার পরেও তাদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়া ঠিক রাখার জন্য বেশ কিছু আফ্রিকান দেশের অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব তাদের হাতেই ধরে রেখেছে।
বর্তমান শতাব্দীতে উপনিবেশিকতার ধরন ও প্রক্রিয়া দুটোই পাল্টেছে। পৃথিবীতে সম্ভবত একমাত্র উপনিবেশ হিসেবে টিকে আছে ফকল্যান্ড আইল্যান্ড। আর্জেন্টিনার নিকটের এই দ্বীপপুঞ্জ এখনও ব্রিটিশ উপনিবেশ। ব্রিটিশরা লুন্ঠন ও উপঢৌকনে সাজিয়েছে তাদের দেশ। ব্রিটেনের রানির মাথার মুকুটের কোহিনূর এই অঞ্চল থেকে উপঢৌকনের নাম করে নিয়ে যাওয়া।
পৃথিবীর সবচেয়ে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহাদেশ আফ্রিকাকে বলা হয় ফ্রান্সের 'রান্নাঘর'। পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকার ২৪টি দেশ ফ্রান্সের কলোনি। এর প্রায় সবগুলোই ১৯৬০ সালে এবং বাকি ২-১টি দেশ ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল ও রুজভেলটের উপনিবেশ বিলুপ্ত করার সেই সিদ্ধান্তের ফলেই ফরাসিরা আফ্রিকার দেশগুলো থেকে উপনিবেশিকতা শেষ করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এই স্বাধীনতা নিঃশর্ত ছিল না।
ফ্রান্স কলোনিগুলোতে শাসনকালে যে গুটিকতক অবকাঠামো তৈরি করেছিল, তার দায়ভার আজও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বহন করে চলেছে। সে তুলনায় ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশসহ অন্য দেশগুলোতে এই অঞ্চলে শর্তহীন স্বাধীনতা প্রদান করেছিল। এই অঞ্চলের হাসপাতাল, স্কুল, বিচারালয়, সেতু, রেললাইনসহ কোনো অবকাঠামোকে ঋণ হিসেবে দেখায়নি।
স্বাধীনতার শর্ত অনুযায়ী ফরাসিরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ১৪টি দেশের জাতীয় আয়ের সবটা এফএএফসি নামক ফরাসি নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংকে বাধ্যতামূলক জমা রাখতে হয়। কোনো দেশ প্রয়োজন হলে জমাকৃত অর্থের মাত্র ১৫ শতাংশ একবাবে তুলতে পারে। এর বেশি প্রয়োজন হলে ওই ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হবে। সুদ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতোই। এই তহবিলের সবটা ফরাসিরা নিজের মত করেই লগ্নি করে থাকে। এর লভ্যাংশের কোনো হিসেব তারা ওই দেশগুলোর কাছে দেয় না। ধারণা করা হয়, এখানে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ রয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানের প্রশ্নে সরাসরি উপনিবেশিকতা ত্যাগ করার পূর্বে ফ্রান্স পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে এক অসম চুক্তি সম্পাদন করে রাখে। এই দেশগুলোর তখনকার জাতীয়তাবাদী নেতারা ক্ষমতার মোহে এবং নিজেদের অর্থবিত্তের প্রয়োজনে ফরাসিদের সেই সমস্ত চুক্তি মেনে নেয়। চুক্তিতে বলা হয় দেশগুলোর সব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের প্রাথমিক দাবিদার হবে ফ্রান্স। ফ্রান্সের কোম্পানিগুলো যদি কখনো আগ্রহ না দেখায়, তখনই কেবল সে দেশগুলো অন্য কোনো দেশ দিয়ে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারবে! খনিগুলোতে ইউরিনিয়াম, ডায়মন্ড, স্বর্ণ, আয়রনসহ মহামূল্যবান সম্পদে পরিপূর্ণ।
আফ্রিকার আরেক দেশ গ্যাবন। দেশটি আলোচনায় আসে গত মাসে। সেখানে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বাবা ও ছেলের ৬০ বছরের শাসনের অবসান হয়। গ্যাবনে রয়েছে বিশাল ইউরেনিয়ামের মজুদ। ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোর জন্য এই ইউরেনিয়াম অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি অভ্যুত্থান হয়েছে নাইজারে। সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ফ্রান্সের অনুগত সরকারকে উচ্ছেদ করেছে সামরিক জান্তা এবং ফরাসিদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষয় তারা দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এই ফরাসিদেরই।
তবে ধীরে হলেও পরিস্থিতির বদল ঘটছে। গত মাসে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের সম্প্রসারিত অংশের আফ্রিকার দুটি দেশকে যুক্ত করা হয়েছে। ফরাসি আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধাগুলো পেরুতে হলে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। পৃথিবীর আধুনিক যুগের বয়স প্রায় ৫০০ বছর হতে চলল। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর উপনিবেশিক চুক্তিগুলো দেখলে বিভ্রান্ত হতে হয়, মনে হবে পৃথিবী এখনও মধ্যযুগে রয়েছে। মানুষ তার রূপরসটাই দেখাতে চায়। অসুন্দর বা ক্ষতটাকে আড়াল করতে চায়।
ফরাসিদের বিরুদ্ধে ভারতের রাফায়েল বিমান বিক্রির সময় সংঘঠিত ব্যাপক দুর্নীতির কথা ভারতের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের প্রধান কারণ আমাদের জনগণের কাছে স্পষ্ট না হলেও কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ফরাসিদের এয়ারবাস বিক্রির প্রচেষ্টা ও স্যাটেলাইট বিক্রির পরিকল্পনা কতটুকু সত্য, সে ব্যাপারে এখনও সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে কোনো তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে আধুনিককালের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ফরাসিরা রাফায়েল বিমান বিক্রির ক্ষেত্রে ভারতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর বাংলাদেশ সফরের সময়কালটা তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় টানা তিন মেয়াদে থাকা দলটির বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদেতার অভিযোগ করছে বিরোধী দলসমূহ বেশ জোরেসোরেই। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে গণমানুষের উপস্থিতি নানা ধরনের পুলিশি বাধার পরেও নেহাত কম নয়। বিরোধী দলগুলো এই সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রশাসন দলীয়করণ করা, সুষ্ঠু-অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা না থাকা, পুলিশি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা, মানবাধিকার হরণ করা, দেশের প্রথম মানবাধিকার কর্মীকে সাজা প্রদানের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা, ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি ও অর্থপাচার, বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি অভিযোগ করে আসছে অনেকদিন ধরেই। এদিকে পশ্চিমা ক্ষমতাধর দেশগুলোর কূটনীতিকরাও নানা তৎপরতা দেখাচ্ছে।
একের পর এক মার্কিন প্রতিনিধিদল আসতে থাকে বাংলাদেশে। যেকোনো পক্ষ থেকে অগণতান্ত্রিক বা সহিংস ঘটনা ঘটালে তাদের জন্য মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা জানায় মার্কিন প্রশাসন। পশ্চিমা তৎপরতায় স্থানীয় আন্দোলনকারিরা বাড়তি শক্তি পায়। সরকারও বসে থাকেনি। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো একের পর এক সামনে আনতে থাকে এবং অন্যদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে থাকে। সরকার তাৎক্ষণিক ফলও পায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস সম্মেলন ও সদ্যসমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে সদস্যরাষ্ট্র না হওয়া সত্ত্বেও আমন্ত্রণ পায়। এই দুই সম্মেলনে অংশগ্রহণের সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ মরিয়া চেষ্টা চালায়। মূল অধিবেশনে ভাষণ দেওয়া, সাইড লাইন মিটিং ও দ্বিপাক্ষিক মিটিং করারও সুযোগ পায়। এই মিটিংগুলোর মধ্যদিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের সরকার প্রধানদের সাথে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি (সেলফি), ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে আমাদের সরকার প্রধানের আন্তরিক পরিবেশের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। জো বাইডেনের হাসির মতোই আমাদের সরকার ও তার দলের হাসি আরও চওড়া হয়েছে।
জো বাইডেন জি-২০ সম্মেলন শেষ করে ভিয়েতনাম সফরে ভারত সরকারে সাম্প্রদায়িকতা তোষণ ও মানবাধিকার লংঘনের সমালোচনা করেছেন। মাত্র একদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে জো বাইডেনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আন্তরিক পরিবেশে হাস্যোজ্জ্বল ছবির কোনো কমতি ছিল না।
জি-২০ সম্মেলন শেষে ফরাসি প্রেসিডেন্ট দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালিন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতোরাঁ বাংলাদেশ সফর করেন। প্রায় ৩৩ বছর পর ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই আগমন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ এয়ারবাস কেনার পাশাপাশি স্যাটালাইট উৎক্ষেপনের চুক্তিও করেছে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাথে। এইসব রাষ্ট্রীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে বেরিয়ে পড়েন শিল্প-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি দর্শনে। পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট নিজেও শিল্প-সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী মানুষ। তিনি আমাদের দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীত দল জলের গান এর স্টুডিও পরিদর্শন করেন। জলের গানের পরিবেশনা উপভোগ করেন এবং দলপ্রধান রাহুলের কাছে একতারা বাজানোর কৌশল জেনে নেন। প্রেসিডেন্ট মাখোঁ নিজেও একজন সৌখিন গিটার বাদক। এরপর তিনি ছুটে যান তুরাগ নদীর ধারে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি নৌকা চড়েন, নৌকা বাইচ দেখেন এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা খান। আমাদের মুগ্ধতার ঘোর কাটে না।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।