পুতিন বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত করলে কী হবে?

বর্তমান যুগের বাস্তবতায় সহজেই ইন্টারনেট বা অন্তর্জালকে ইথার-বাহিত, বায়বীয় এক পরিষেবা ভাবার ভুল অনেকেরই হতে পারে। এই যে আমরা অফিস বা বাড়ির কাজে দৈনিক তারবিহীন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হচ্ছি; নিজেদের দরকারি তথ্য সংরক্ষণ করছি ক্লাউডে; বা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজেই পাঠাচ্ছি তথ্য – তাতে এ ধারণাই রসদ পায় প্রতিদিন।
কিন্তু ধারণাটি একেবারেই সঠিক নয়। বরং বিশ্বের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক অনেক বেশি মাত্রায় ভৌত অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, যার ওপর নানান আঘাত আসার ঝুঁকিও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক ডিরেক্টর অব অপারেশন্স মার্শাল এডওয়ার্ড স্ট্রিংগার জানান, আন্তর্জাতিক ডেটার অন্তত ৯৫ শতাংশ সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত সীমিত সংখ্যক কিছু কেবল বা তারের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। এ ধরনের কেবলের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। বাগানে গাছে পানি দিতে যেমন নল ব্যবহৃত হয়, তার মতোই এর প্রতিটির প্রস্থ। তবে প্রতি সেকেন্ডে ২০০ টেরাবাইট ডেটা পরিবহনে সক্ষম।
ভৌত এসব অবকাঠামো দিয়েই দৈনিক প্রায় ১০ লাখ কোটি ডলারের সমান আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। স্ট্রিংগার ব্যাখ্যা করেন, গত দুই দশকে সাগরতলের এসব কেবল নেটওয়ার্কে হামলা চালানোর মতো বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছে রাশিয়া। ঠিক এই ধরনের হামলার জন্য বর্তমানে মানবহীন, অত্যাধুনিক সাবমার্সিবল যানের বহর রয়েছে ক্রেমলিনের কাছে। চীনেরও রয়েছে এমন বহর। ফলে এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, রাশিয়ার সাথে সশস্ত্র সংঘাতের পরিণতিতে সাগরতলের কেবলগুলো আক্রমণের শিকার হবে।
সমর পরিকল্পনাবিদেরা নানান সম্ভাবনাকে মাথায় রাখেন। এর অনেক কিছুই তাত্ত্বিক। কিন্তু, এটি কোনো তাত্ত্বিক হুমকি নয়। ২০২২ সালের অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের সাথে বাকি বিশ্বের ইন্টারনেট সংযোগ রক্ষাকারী একটি সাবমেরিন কেবল দুই জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়। এর কয়েকদিন আগেই রাশিয়ার একটি 'বৈজ্ঞানিক গবেষণা' জাহাজকে ওই এলাকায় দেখা গিয়েছিল। তবে এ কাজ রাশিয়ার, তা প্রমাণ করা ছিল অসম্ভব। আসলে বেশিরভাগ সময়েই মাছ ধরার ট্রলারের দীর্ঘ জালে জড়িয়ে, বা সাগরতলে ভূকম্পনের মতো ঘটনায় সাবমেরিন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তারপরও ঘটনাস্থলে রাশিয়ান জাহাজের উপস্থিতির এই ঘটনায় রীতিমতো নড়েচড়ে বসে পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। গভীর উদ্বেগ দেখা যায় তাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা অনুমান করেন, এই ঘটনার মাধ্যমে ক্রেমলিন এক হুঁশিয়ারি পাঠিয়েছে।
এক কথায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে সাবমেরিন কেবল নিয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করছে না, একইসঙ্গে তার প্রতি হুমকিও তৈরি করছে।
এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। দক্ষিণপশ্চিম এশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে ১১,৯৩০ মাইল দীর্ঘ সাবমেরিন কেবলের নেটওয়ার্ক স্থাপনে কাজ করছিল আন্তর্জাতিক বেশ কিছু কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম। ফেব্রুয়ারিতে চীনের দুটি বৃহত্তম টেলিযোগাযোগ কোম্পানি এই কনসোর্টিয়াম থেকে সরে গেলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে বাস্তবায়ন কাজ।
সহযোগিতা বন্ধ হওয়া একটা বাধা, কিন্তু সাগরতলের কেবলে আক্রমণ অন্য মাত্রার বিপদ ডেকে আনবে। যার ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে অপরিমেয়। এ ধরনের আক্রমণে বিপর্যস্ত হতে পারে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য, ব্যাংকিং, আর্থিক সেবা, টেলিযোগাযোগ। প্রযুক্তি ও যোগাযোগ শিল্পে এর কতোটা মারাত্মক প্রভাব পড়বে, তাতো বলাই বাহুল্য। এমনকী বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। ক্ষতির মাত্রা এখানেই শেষ নয়। একুশ শতকে পণ্য পরিবহন ও জোগান ব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রায় তথ্য বিনিময়ের ওপর নির্ভরশীল। এই তথ্য প্রবাহে যেকোনো বিচ্ছিন্নতার ধারাবাহিক প্রভাব পড়বে উৎপাদন ব্যবস্থায়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিনিময়ও এতে বাধাগ্রস্ত হবে।
তার চেয়েও বড় কথা, এ ধরনের আক্রমণে সুদূরপ্রসারী যে আর্থিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে না। সাবমেরিন কেবল বিচ্ছিন্ন করে কোনো দেশকে এমন বহুমুখী সংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া সম্ভব, যা মোকাবিলা করা হবে প্রায় অসাধ্য। কোনো সন্ত্রাসী বা বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই কাজ করে, প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি দায় চাপাতে পারে। বাধিয়ে দিতে পারে দেশে দেশে যুদ্ধ। এই ধরনের কূটচালে তারা সংঘাত উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের মিত্রতায় চিড় ধরাতে বা জোট গঠনেও পরিবর্তন আনতে পারে।
ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এ ধরনের আক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে, স্বাধীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রাযুক্তিক সক্ষমতা থাকা দেশ এতে কৌশলগত সুবিধা পাবে।
এ ধরনের দৃশ্যপটকে তাই অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় চলাচলের অধিকার সকল দেশেরই রয়েছে। সেখানে নৈরাজ্য সৃষ্টির সুযোগও রয়েছে। কারণ বিদ্যমান আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো যথাযথভাবে সাবমেরিন কেবলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি। এটি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থারই এক প্রতিফলন – যেখানে জন-নিরাপত্তায় ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও – সাবমেরিন কেবলগুলোর ভৌত বা আইনি নিরাপত্তায় ঘাটতি রয়েই গেছে।
তবে এ পর্যন্ত বিশ্বশক্তিগুলো সমকক্ষ প্রতিপক্ষের সাবমেরিন কেবলে বড় পরিসরে হামলা করেনি। এতে পাল্টা-আঘাত আসার হুমকি বিবেচনায় নিয়েই তা থেকে বিরত আছে। কিন্তু, পৃথিবীর বর্তমান শক্তির ভারসাম্য বেশ অস্থিতিশীল – রাতারাতি যা বৈশ্বিক ইন্টারনেট নেটওয়ার্ককে ব্যাহত করার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
ফলে সাবমেরিন কেবলের ওপর হামলার ঘটনায় – পশ্চিমা বিশ্বের সাথে চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সংঘাত কতোটা মারাত্মক হতে পারে – তা শুধু আমরা কল্পনাই করি, কিন্তু বাস্তবতার সাথে মেলাই না। আধুনিক সময়ের বাস্তবতা এই যে, তথ্যের লেনদেন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থায় নেমে আসবে গভীর বিপর্যয়। রাষ্ট্র পরিচালনাও হবে দুষ্কর। ইন্টারনেট আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অগণিত যে সুবিধা দিচ্ছে, রাতারাতি তার অনুপস্থিতি নৈরাজ্য ডেকে আনবে। অথচ এসব অবকাঠামো রক্ষা করাটাও বেশ কঠিন।
সামরিক ও আর্থিক শক্তিতে বলীয়ান পশ্চিমা দুনিয়া 'অজেয়' – এমন চিন্তা বাস্তবতাবর্জিত। সাগরতলদেশের কেবলগুলো যে পশ্চিমাদের অবকাঠামোগত দুর্বলতার স্থান, সে সম্পর্কে প্রতিযোগী দেশগুলো সচেতন। তারা অনুধাবন করেছে, এই 'চোক পয়েন্ট'গুলোকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে তারা চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারে। ভূরাজনৈতিক বিরোধ যতই থাকুক, এই প্রেক্ষাপট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সহযোগিতার ন্যূনতম একটি মাত্রা বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে।
আমাদের স্মরণে রাখা উচিত, বিভিন্ন দেশের একে-অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা কূটনীতিকদের বহুল চর্চিত কোনো ধারণা শুধু নয়। আজকের দুনিয়ায় এটাই সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আধুনিক সময়ে আঞ্চলিক কোনো সমস্যা, ঝুঁকি বা হুমকি অতিদ্রুত বৈশ্বিক রূপ নেয়। যেগুলো মোকাবিলায় সরকারগুলোর পদক্ষেপ অধিকাংশ সময়েই শুধু জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু, কিছু বিষয় আছে যার সমাধান কেবল বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই করা সম্ভব।