বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ রাষ্ট্র পরিচালনায় সব সময় কল্যাণকর হয় না

ভারতের বিচার বিভাগ কি স্বাধীন? এ প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে বারবার। ভারতীয় বিচার বিভাগ, অতি সম্প্রতি গুজরাটের একটি আদালত, তৃতীয় পক্ষের এক মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীকে দুই বছরের সাজা প্রদান করেছে। ইতঃপূর্বে ২০১৩ সালে এক রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত দণ্ডিত ব্যক্তিকে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছে। তখনকার সে রায় কোন কোন ধরনের মামলায় সাজা তা উল্লেখ করেনি। ফলে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে এ মামলাটিকে যেভাবে সেই দুই বছরের তকমা লাগিয়ে দেওয়া হলো তা সবার কাছেই স্পষ্ট যে, এ বিচারক সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার জন্যই কাজটি করেছেন।
রাহুল গান্ধীর কিছু কিছু বক্তব্য পার্লামেন্টের মধ্যে এবং কিছু বক্তব্য সংসদের বাইরের। একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যে মামলা হয়েছে তার সর্বোচ্চ সাজাই দু'বছর। আর এ দু'বছর ল্যান্ডমার্কটি সৃষ্টি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের ফলে।
সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ের ফলে ইতোমধ্যে বেশ কয়জন সংসদ সদস্য তাদের সদস্যপদ হারিয়েছেন। যার মধ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সাংসদ আছে। রাহুল গান্ধী তার সংসদ সদস্য পদ হারাবেন তা-ই স্বাভাবিক এবং ক্ষমতাসীন বিজেপি এক কদম এগিয়েই ছিল। আর এটা প্রমাণ হলো রায় ঘোষণার পরের দিনই রাহুল গান্ধীর সদস্য পদ বাতিল হওয়া থেকে।
রাহুল গান্ধীর সাজা মাত্রা দু'বছর হলেও মামলাটি একেবারেই ভিন্নধর্মী। মামলার বিষয়বস্তু হচ্ছে মানহানির মামলা। যে মামলার শুরু হয়েছে রাফায়েল বিমান ক্রয়কে কেন্দ্র করে।
রাহুল গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করেছিলেন। তারপর গুজরাটের ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে আরও দুই-তিনবার মোদির নাম জড়িয়ে পড়ায় রাহুল গান্ধী দুর্নীতিতে মোদিরা এত কমন কেন — এমনি একটি প্রশ্ন রাখেন। যাকে কেন্দ্র করে এ মামলা — ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি — তিনি এ মামলার বাদী হননি। আর মামলার রায়ের শুনানির পরে রাহুল গান্ধীকে গুজরাট রাজ্যের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দুই বছরের সাজা প্রদান করেন।
২০১৩ সালেও সুপ্রিম কোর্ট লিলি থমসন ভার্সেস ইউনিয়ন মামলায় এমন রায় প্রদান করেছিলেন, যে রায়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই রায়কে কেন্দ্র করে সংবিধানের ধারার পরিবর্তন করা হয়: যে আইনের ধারায় বলা ছিল রায়টি প্রদানের তিন মাস পর্যন্ত স্থগিত থাকবে যদি সংসদ সদস্য হয়। সুপ্রিম কোর্ট তাও বাতিল করে দিয়েছিলেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধী নিজেও ২০১৫ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দেন।
বর্তমানে রাহুলের বিরুদ্ধে এমনি আরও ১০টি মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে বিদ্যমান। এর পাশাপাশি আবার দেখা যায় বিজেপির সংসদ সদস্যরা সংসদের বাইরে বা ভেতরে উভয় জায়গায় নানা মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করছেন। কিন্তু রাহুল গান্ধী কখনো আদালতের শরণাপন্ন হননি মানহানির মামলা নিয়ে।
বিজেপি প্রতিনিয়ত মানহানিকর নানান শব্দ ব্যবহার করে সারাদেশে তোলপাড় করছে রাহুলকে কেন্দ্র করে। ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার এ বিষয়গুলোর সামনে আসাতে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক অঙ্গনের বিতর্ক রাজনৈতিকভাবেই সুরাহা হওয়া উচিত। বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ এ বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তোলে, সমাজে আরও বেশি বিভাজন তৈরি করে।
বর্তমানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসসহ যে সমস্ত বিরোধী দল আছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল ও সংঘর্ষিক হচ্ছে। যা ভারতের সামাজিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলবে। এতে আপাতত মনে করা যেতে পারে, বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ সংবিধান এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সময় কল্যাণ ডেকে আনে না। কখনো কখনো এমন বিভাজনের সৃষ্টি হয় যার ফলে সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপমহাদেশের কয়েকটি দেশেই নানান সময় বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপের কারণে মারাত্মক সংকট সৃষ্টির নজির রয়েছে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।