ইরান-সৌদি চুক্তি: চমকাল দুনিয়া, টানাপোড়েন থেকে সহযোগিতার সড়কে

ইসরায়েলি-নেতারা বছরের পর বছর ধরে তেহরানকে তেলআবিবের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছেন। অন্যদিকে সৌদি আরবকে নিজেদের সম্ভাব্য সঙ্গী হিসেবে ভেবেছেন। তেহরানকে নিয়ে রিয়াদ-তেলআবিবের ভীতি সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের দরজা খুলে দেবে—এমন ভাবনায়ও ডুবে ছিলেন তারা।
তবে ১০ মার্চ শুক্রবার ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তির খবর ইসরায়েলকে চমকে দেয়। পাশাপাশি তেলআবিবের নেতৃকুলের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। দেখা দেয় নিজেদের তৎপরতাকে খতিয়ে দেখার তাগিদ। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের নীতিমালা যখন ইসরায়েলের ভেতরে বিভেদ বাড়িয়ে চলেছে তখন এই খবর প্রকাশিত হলো। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় হুমকিকেই দেখতে পায় তেলআবিব। নেতানিয়াহু নিজেকে ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষম একমাত্র নেতা হিসেবে তুলে ধরার অন্তহীন কোশেশ করেছেন বছরের পর বছর ধরে। পাশাপাশি সৌদি আরবকে বশ করার মোহজাল কেবল তিনিই বিস্তারের ছলাকলা জানেন, এমন ভাবও সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতা চুক্তির খবরে নেতানিয়াহু পড়েছেন সরাসরি ক্যাচ আউট হওয়ার দশায়।
তেলআবিব বহুকাল ধরে স্বপ্ন দেখেছে, ইরানের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক মিত্রদের নিয়ে জোট গঠন করবে। মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই ইরানের পক্ষে এমন কথা কেউ বলবে না। এমনকি কোনো কোনো দেশ ইরানে আচরণে হুমকির গন্ধও পায়। তবে ইসরায়েলে যে ভাবে খেয়ে না খেয়ে ইরানের বিরুদ্ধে মালকোঁচা মেরে নেমেছে সে ভাবে নামতে রাজি নয় এসব দেশ। তাদের হিসাব-কিতাব হলো, ইরানকে একঘরে করার প্রাণান্ত প্রয়াসের বিনিময় তাদের ঘরে খুব কমই সুফল যোগ হবে। ইরানে রাহবার হিসেবে সম্মানিত সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল সাইয়্যেদ খামেনের ফতোয়ায় পরমাণু অস্ত্রকে 'হারাম' ঘোষণা করা হয়েছে। তেহরানে বারবার বলছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। তারপরও ভয় কাটেনি। তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বোমা তৈরির কর্মসূচি হিসেবে দেখছে ইসরায়েল। এ কর্মসূচিকে তেলআবিবের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। রিয়াদের আচরণ থেকে স্পষ্ট হলো, পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তেহরান নিয়ে যা-ই ভাবুক না কেন, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাকে এখন তারা নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন বলে হিসাব কষছে।
পারস্য উপসাগরীয় যখন এই বাস্তবতা বুঝতে শিখছে তখন ইসরায়েলরে পরিস্থিতি কি? নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্যাট্রিক কিংসলি ১০ মার্চ জেরুজালেম থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেন, উপসাগরীয় বাস্তবতা ইসরায়েলিদেরকে নিজেদের তৎপরতা আবারও খতিয়ে দেখার তাগিদ দিচ্ছে। তেলআবিবের বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের সরকারি বিতর্কিত প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের বিভক্তি দেখা দিয়েছে। সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারছেন তাদের নজর যখন অন্যদিকে তখনই ইরান-সৌদি আরবের দীর্ঘ টানাপড়েন অবসানের পথে চলেছে।
তেহরান-রিয়াদ চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি জখম হয়েছেন নেতানিয়াহু। বহু বছর ধরে পররাষ্ট্রনীতির দুই রণপার ওপর ভর করে চলছিলেন তিনি। তার একটি হলো, তেহরানকে একঘরে করা। অন্যটি হলো, রিয়াদের সাথে তেলআবিবের সম্পর্ককে স্বাভাবিক পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। সৌদি আরবের সাথে যতই মাখামাখির পর্ব চলুক না কেন, এখনও তেলআবিবকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পুষ্পস্তবক অর্পণ করেনি রিয়াদ।
রিয়াদ-তেহরান চুক্তিকে ইসরায়েলের বিরোধী দলের নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়ারি লাপিদ বলেন, সৌদি আরব ও ইরানের চুক্তি হলো ইসরায়েলের পরররাষ্ট্রনীতির পুরোপুরি এবং বিপজ্জনক ব্যর্থতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে এ কথা বলেন তিনি।
ইতালি সফররত নেতানিয়াহু এ চুক্তি নিয়ে তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক কোনো কথাবার্তা বলেননি। এমনকি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে যে অনুরোধ করা হয়েছিল, তা-ও প্রত্যাখ্যান করেছে নেতানিয়াহুর দফতর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি এক উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা সাংবাদিকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমে। মনে করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে নিজ সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন খোদ নেতানিয়াহু। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া ল্যাপিডের প্রশাসনকেই ইরান-সৌদি চুক্তির জন্য দায়ী করা যেতে পারে।
ইরান ও পারস্যবিষয়ক কোনো কোনো ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ এ চুক্তিকে বিনা মেঘে বজ্রপাত হিসেবে দেখছেন না। রিয়াদ তেহরানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা করছে, সে কথা সবাই জানেন।
এদিকে ইরানের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণের দিকে নজর দিলে এ চুক্তিকে তেহরানের বিজয় হিসেবেই মনে করছেন পারস্যের বিশ্লেষকরা। অনলাইনে প্রকাশিত সংস্করণে হামশাহরি দৈনিকে এ চুক্তিকে বিশ্লেষণ করেন মোস্তফা খোশ-চেশি। ইরান-সৌদি পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ খোশ-চেশি বলেন, রাইসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক ও প্রতিবেশী দেশগুলোর এ বাণিজ্য বেশ বেড়েছে। সৌদি আরবের মতো বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেশগুলোর সাথে উত্তেজনা কমানো ব্যতিরেকে মানুষের জীবনের মানোয়ন্ননের কর্মসূচি কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারে না।
বাগদাদে সৌদি আরবের সাথে ইরানের কয়েক দফা বৈঠকও হয়। রাইসির সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় এ বিষয়টি তোলা হয়। চীন এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা নেয়। শেষ পর্যন্ত রিয়াদ ও তেহরান সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দেয় বলে জানান খোশ-চেশি। তিনি আরও জানান, একসময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে যুদ্ধ করার আহ্বানও জানিয়েছিল সৌদি আরব। তবে ট্রাম্প বেশ আনুষ্ঠানিকভাবেই ঘোষণা করেন যে সৌদির দাবি মেনে নিয়ে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবেন না। সেঅ থেকেই সৌদি আরব বুঝতে পারে তাকে ভারবাহী ষাঁড় বা দুধেল গাভী বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কাজেই কেবল সমর্থন দেবে আমেরিকা। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব বুঝতে পারে যে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েত যে পথে কয়েক মাস আগে থেকেই হাঁটছে, একই পথে রিয়াদের হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। দেশ দুটি তাদের রাষ্ট্রদূতদের তেহরানে ফেরত পাঠিয়েছে।
এই চুক্তির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকা ও ইসরায়েল হবে বলেই এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন। এছাড়া তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী ইয়ারি লাপিদ ও নাফতালি বেনেটের কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তেলআবিবের পররাষ্ট্র বিশেষ করে ইরাননীতি মারাত্মক চোট খেয়েছে। ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পশ্চিম এশিয়ায় চীন রাজনৈতিকভাবে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু এ মধ্যস্থতার মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা কমাতে চীন এবারে জোরালো রাজনৈতিক অবস্থান নেবে। আর চীনের এ ভূমিকাকে আমেরিকার জন্য বড় পরাজয় বলেও মনে করেন তিনি। অবশ্য ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদির সহযোগিতার সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যাবে বলেও তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব 'এক হাওয়া দো বাম' বা একই ছাদের তলে দুই রকম আবহাওয়া, অর্থাৎ সরল বাংলায় দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে। ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তার ঘটানো মানে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি নয়। এতে কেবল ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের গতি কমবে। বন্ধ হবে না মোটেও। এছাড়া এ চুক্তি টেকসই বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে ইরানের সাবেক কূটনীতিবিদ সাইয়্যেদ সাবাহ্ জাঙ্গানে একই দৈনিককে দেওয়া পৃথক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ চুক্তির ফলে ইয়েমেনের যুদ্ধ হয়তো বন্ধ হবে না। ইরান ও সৌদি আরব এ যুদ্ধ নিয়ে এখন কোনো আলাপ করছে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের ভিত্তি স্থাপনে দুদেশকেই দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে কাজ করতে হবে।
রিয়াদ-তেহরান চুক্তি সই করার পর কর্মদিবসের প্রথম দিনটি ছিল ১১ মার্চ শনিবার। ইরানি অনলাইন সংবাদপত্রের খবরের ভিত্তিতে জানা যায়, এদিন ডলার মার্কেটে ডলার কেনার জন্য খদ্দেরদের লাইন দেখা যায়নি। গত কয়েক দিনের তুলনায় যা ব্যতিক্রম। এছাড়া ডলারের দাম কমেছে। এদিকে ইরানের বাজারে যে স্বর্ণমুদ্রা বিক্রি হয়, তারও দাম কমেছে। সংবাদে বলা হয়েছে, তেহরান-রিয়াদ চুক্তির সুফলের সুবাতাস বইছে ইরানের বাজারে।