সরকারের ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা ও তার সম্ভাব্য প্রভাব

করোনা নামক বৈশ্বিক মহামারির কারণে আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। ৭৮০ কোটি মানুষের বিশ্বে প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছা-বন্দি জীবনযাপন করছে। বৈশ্বিক মহামন্দার কবলে বিশ্ব অর্থনীতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও এখন বিপর্যস্ত। মানুষ করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে অস্থিরতা, অভাব অনটন। আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে, চলেছি এসডিজি পূরণের লক্ষমাত্রা নিয়ে। আমরা জানি গত কয়েক বছর ধরে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রতি বছর ১০০ থেকে ১৫০ ডলার । ২০১৮-১৯ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৯০৯ ডলারে।
অন্যদিকে, গত ২০১৯ সালের জুন মাসের শেষে দেশের দারিদ্র্য হার সাড়ে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, ২০১৬ সালে যা হার ছিল ২৪ শতাংশ। অতি দারিদ্র্য হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে যা ২০০০ সালে ছিল ৩৫ শতাংশ। তথ্যমতে, বাংলাদেশের গরিব প্রায় পৌনে ২০ লাখ পরিবারের মাসিক গড় আয় ৭৪৬ টাকা, সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবার তারা (২০১৬ সালের চিত্র; সূত্র: বিবিএস)।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি উত্তরণে সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সরকারের এই প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তার পাশাপাশি প্রশ্ন হচ্ছে, এই উত্তরণ প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে এবং যাদের টাকা প্রকৃতপক্ষে দরকার টাকাটা তাদের কাছে পৌঁছুবে কি না।
আমরা বুঝতে চেষ্টা করি আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ একমাসের কম সময়ের মধ্যে খাদ্য সংকটে কেন পড়ল। দেশের হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ, তাদের খাবার সংকট হতে পারে, কারণ তারা দিন আনে দিন খায়। বাকি মানুষের তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা নয়।
ধরুন, একজন চাকরিজীবী বা ছোট ব্যবসায়ী ১০ বছর, কেউ ২০ বছর কেউ বা ৩০-৪০ বছর আয় করেছেন। ১০ বছর থেকে ৪০ বছর ধরে আয় করা একটা মানুষ/পরিবার একমাসের চলার টাকা সঞ্চয় করে রাখতে পারেনি? আমরা বাঙালিরা কি বেশি ভোগবিলাসী? কেউ কথাটা অন্যভাবে নিবেন না বলে আশা করি। আমরা কি যা আয় করি তার পুরোটাই খরচ করি, নাকি তার চেয়ে বেশি খরচ করি, নাকি যা আয় করি তা-ই খরচ করি?
আমার প্রথম কথাটি হচ্ছে, আমাদের দেশের জনগণকে নিজের আয়ের চেয়ে কম খরচ করার অভ্যাস করতে হবে যাতে হঠাৎ পরিবারে কোনো ধরনের সংকট আসলে অন্তত দুই তিনটা মাস চলা যায়। এটা কিন্তু অভ্যাসের ব্যাপার; সামর্থ্যের ব্যাপার নয়। এই অভ্যাস করতে পারলে সামগ্রিকভাবে সমাজে সঞ্চয় বেড়ে যাবে, আকস্মিক কোনো বিপদে মানুষকে মুষড়ে পড়তে হবে না।
হতদরিদ্র লোক নন কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্যে যারা আছেন, তারা কিন্তু অল্প হলেও আয় করেন। যেমন ধরুন রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, পান-বিড়ি বিক্রেতা, প্রান্তিক ব্যবসায়ী- এই ধরনের লোকজন কিন্তু অন্তত একমাস দুইমাস যেটুকু সঞ্চয় আছে তা দিয়ে, অল্প আয় বা ধার-দেনা করে চলতে পারেন। অতি সঙ্কটে যদি তাদের শুধু চাল-ডাল-তেলের ব্যবস্থা হয়, তাহলে তারা আপাতত বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারেন। ঢালাওভাবে প্রণোদনা আসলে দরকার ছিল কি না, সেটাও প্রশ্নের দাবি রাখে।
এটা একটা আকস্মিক বিপদ। এই বিপদে মানুষের কৃচ্ছতা সাধন জরুরি- এটা সব মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। সমাজের ধনিকশ্রেণির গরিব প্রতিবেশী ও জনগনের পাশে দাঁড়ানো দরকার এবং অনেক মানুষ তা করছেনও। তাহলে এই প্রণোদনার কি দরকার ছিল? অবশ্যই ছিল; কিন্তু সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা কি প্রকৃত টার্গেট গ্রুপের কাছে পৌঁছাবে? যদি পৌঁছায়, তাহলে সেটা অর্থবহ হবে।
আবার প্রশ্ন হচ্ছে, এই টাকাটা সরকার কিভাবে আয় করবে? সরকারের কি সেই সক্ষমতা আছে যে ধার করে দেশের সবার জন্য দানের ব্যবস্থা করবে? যদি থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। আমরা ইতোমধ্যে জানি সরকার শুধু ব্যাংক বাবস্থা থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৬-৫৭ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। সরকারের হাতে অসংখ্য মেগা প্রজেক্ট। এইসব প্রজেক্ট চালিয়ে নেওয়া, আবার সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র চালাতে অত টাকা, সাথে প্রণোদনা সরকার সামাল দিবে কিভাবে? ঢালাও প্রণোদনা দিয়ে যে লাভ হবে, তা আবার অন্যদিক থেকে খরচ হয়ে বের হয়ে যাবে না তো? এটাও দেখার বিষয় আছে।
এবার একটু প্যাকেজগুলা মূল্যায়নের চেষ্টা করা যাক।
প্যাকেজ-১: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
এখানে এক বছরে সরকারের সুদ বাবদ খরচ হবে ১৩৫০ কোটি টাকা। আসলে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই; কিন্তু সবাইকে কেন এই সুবিধার মধ্যে আনতে হবে? যারা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম নন, শুধু তারাই এই সুবিধা পাওয়ার জন্য মনোনীত হওয়া উচিত। তাছাড়া ব্যাংক'কে যখন তার নিজস্ব ফান্ড থেকে এই টাকা ঋণ দিতে হবে, তখন সেটা অনেক ক্ষেত্রে হবে 'তেলা মাথায় তেল' দেওয়ার মতো। অনেকে বঞ্চিত হবেন ঋণ পেতে; কারণ তারা ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন না। অথচ সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লায়েন্ট বাছাই এবং ঋণ প্রদান সংক্রান্ত নিয়মনীতি বিস্তারিত ও সতর্কভাবে প্রণয়ন করবে, আশা করি।
প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান: ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে।
ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এখানেও উপরের কথা প্রযোজ্য। এই ধরনের অনেকে আছেন যাদের কলাট্যারল নেই। এখানেও তারাই ঋণ পাবেন, যাদের ঋণ না হলেও এই অবস্থা থেকে কেটে উঠতে পারতেন বা ব্যাংক থেকে চাইলেই ঋণ পেতেন। যারা ঋণ না পেলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, তারা কি আসলে ঋণ পাবেন? আমার মনে হয় এই (১) ও (২) প্যাকেজের ব্যবসায়ীদের দরকার টাকার প্রবাহ, কম সুদ তাদের ভবিষ্যতে খরচ কমাতে সাহায্য করবে সত্য, কিন্তু ঋণ বা যেকোনোভাবে হোক টাকার প্রবাহ না হলে তারা সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো: ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। উদ্যোগটি মন্দ নয়; কিন্তু প্রকৃত উদ্যোক্তাকে এই ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্যাকেজ-৪: প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ। এটা রপ্তানিকে তরান্বিত করবে। ভালো উদ্যোগ বলা যায়।
প্যাকেজ-৫: এর আগে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এটিও নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সঠিক বেতন ভাতা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে- যেটা তৈরি পোশাক খাতে খুব কঠিন। সরকার নিশ্চিত করবে কিভাবে যে টাকাটা যাদের পাওয়ার কথা তারা পেয়েছেন?
পরিশেষে বলতে চাই, সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন সরকার যাদের টাকাটা প্রকৃতার্থে দরকার তাদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে পারবে। খুব ভালো হতো যদি জাতির এই সঙ্কটকালে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা, অন্যায়ভাবে অর্জিত কালো টাকা, ব্যাংকের খেলাপী ঋণ আদায় করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারত এবং অভাবী মানুষের জন্য কাজে লাগাতে পারত। ভয় ও সন্দেহের মধ্যে থাকতে হয় যে, এই টাকা যাদের দরকার তাদের হাতে না গিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, সমাজের বৈষম্য আরও বাড়বে, টাকা পাচারের সম্ভাবনা বাড়বে , গরিব যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থাকবে। আর যদি তাই হয়, সরকারের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হবে- যা কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়।
তবে অসততা ও ফান্ড অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে দৃঢ় উচ্চারণ, তাতে আমরা আশান্বিত হতে চাই।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক