মার্চে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি দুটিই ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

চলতি অর্থবছরের মার্চ মাসে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ দুটিই আগের বছরের একই মাসের তুলনায় বেড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ায় ব্যাংকিং খাতে ডলারের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মার্চ মাসে ৬.৪৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৬.২৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের মার্চে ৬.০৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছিল। নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের প্রতি মাসেই ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে আমদানি এলসি খোলা হয়েছে।
মার্চে মাসে আমদানি এলসি খোলা কেন বেড়েছে, জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরে 'আমাদের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ডলারের পরিমাণ বেশি। এসব কারণে তারা আমদানি এলসি খোলা বাড়াতে পারছে।'
অফিশিয়াল তথ্য অনুযায়ী, মার্চে বাংলাদেশ ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে—যা দেশের ইতিহাসে এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্তি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১.৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রাপ্ত ১৭.০৭ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২৭.৬ শতাংশ বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশের রপ্তানি খাত ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। এ সময়ের মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৩৪.৬১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বেশি।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের দেশে বিশাল ভোক্তা শ্রেণি রয়েছে। তাদের চাহিদা খুব বেশি কমেনি। ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করে যেতে হয়েছে।'
দুই ঈদ ও বৈশাখকে কেন্দ্র করে ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ে মন্তব্য করে এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার বলেন, 'আমাদের এখন পার্বণের মৌসুম চলছে। একটি ঈদ ও বৈশাখ পার হয়েছে। সামনে আরেকটি ঈদ রয়েছে। তখনকার সময়ের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের একটা বড় অংশের আমদানি এলসি অন্তত কয়েক মাস আগে থেকে খুলতে হয়।'
অফিশিয়াল তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-মার্চ সময়ে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা বেড়েছে প্রায় ১৩.৪১ শতাংশ। গত নয় মাসে ৮.৪৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ৭.৪৪ বিলিয়ন ডলারের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি।
মোহাম্মদ আলী বলেন, 'ব্যাংকগুলোর হাতে ডলার থাকায় তারা ফ্রি-লিমিট এলসি খুলতে সাহস করতে পারছে। এছাড়া আমাদের রপ্তানি বাড়ার কারণে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা বেড়েছে। এসব কারণে আমাদের আমদানি এলসি খোলায় ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানি এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এলসি খোলা বেড়েছে।
কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি
এলসি খোলা বৃদ্ধি পেলেও জুলাই-মার্চ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইসঙ্গে কমেছে মধ্যবর্তী পণ্য ও পেট্রোলিয়াম আমদানিও।
ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বিনিয়োগের দিকে যাচ্ছেন না মন্তব্য করে মোহাম্মদ আলী বলেন, 'মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি এখনও অনেক কম। এ পর্যন্ত আমি খুব বেশি গ্রাহক পাইনি যারা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলতে চায়।'
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো নয় উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি অনেকদিন ধরেই কমছে। এটি ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার মানে হলো, শিল্পগুলো এখন উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনযোগী নয়।
'ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রভাব ফেলছে এই প্রবণতা। এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় চললে অর্থনীতিতে কিছুটা স্থবিরতা চলে আসতে পারে।'
মার্চে এলসি নিষ্পত্তি ১৫ শতাংশ বেড়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত মার্চ মাসে ৬.৩৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের প্রায় ৫.৫৩ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ১৪.৮৩ শতাংশ বেশি।
অর্থবছরের হিসাবে, আমদানি এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৫২.৩৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি পেমেন্ট করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এলসি পেমেন্ট করা হয়েছিল ৪৯.৭২ বিলিয়ন ডলার।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর. এফ. হোসেন বলেন, রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ডলারের প্রবাহ আগের তুলনায় অনেক ভালো। 'এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী অনেক ব্যাংকই এখন ওভারডিউ পেমেন্ট পরিশোধ করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ওভারডিউ পেমেন্ট পরিশোধ করছে। এসব কারণেই এলসি পেমেন্ট বেশি হয়েছে।'
ডলার প্রবাহের এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলে সামনের দিনেও তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করতে ও রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে মন্তব্য করেন এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকিং খাতে ডেফার্ড (বিলম্বিত) এলসির পরিমাণ কমে আশায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর পেমেন্টের চাপ কমেছে। 'আমরা এখন পেমেন্ট শিডিউল করে এলসি খুলছি। ফলে আমাদের ডেফার্ড পেমেন্টের চাপ কমে গেছে।'