রেলের আয় বাড়াতে পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর পরিকল্পনা

বাংলাদেশ রেলওয়েকে লাভজনক ও কার্যকর পরিবহন সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার কৌশল নিতে যাচ্ছে সরকার। এই কৌশলে পণ্য পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি, যাত্রীসেবার মান উন্নয়ন এবং রেল অবকাঠামো সম্প্রসারণের ওপর জোর দেওয়া হবে।
এই কৌশলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কনটেইনার পরিবহন বাড়ানোর অংশ হিসেবে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে সংযুক্ত করা এবং বিদ্যমান সংযোগগুলো শক্তিশালীকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দেশব্যাপী ট্রেন চলাচল বৃদ্ধি করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রামে রুটে দ্রুতগতির বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু এবং নেটওয়ার্কের দক্ষতা বাড়াতে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ড লাইন নির্মাণকে গুরুত্ব দিয়ে এই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এছাড়া ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর-খুলনা-মোংলা, মোংলা-পার্বতীপুর এবং ঢাকা-চিলাহাটির মতো কৌশলগত রেল করিডোর এবং ডেডিকেটেড কনটেইনার করিডোরগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এসব প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য গত ৩০ এপ্রিল পরিকল্পনা কমিশন, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য এম এ আকমল হোসেন আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রেল সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ও রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট
বড় অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত ঢাকা-কুমিল্লা কর্ড লাইনের ডিজাইনের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে চট্টগ্রাম-ঢাকা অংশে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় নতুন কর্ড লাইন ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যমান লাইন দিয়ে কনটেইনার ট্রেন পরিবহন বৃদ্ধি করা যাবে। ৮৩ কিলোমিটারেরর এই কর্ড লাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশের দুরত্ব ৯০ কিলোমিটার কমে আসবে। ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ভ্রমণ সময় ২-২.৫ ঘণ্টায় নেমে আসবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এতে অর্থায়নের জন্য প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ট্রেন চালুর সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজও চলছে। ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলতি বছরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার করিডোরকে ব্রডগেজে রূপান্তর করার জন্য দুটি বড় গেজ-রূপান্তর প্রকল্প নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
একটি প্রকল্প হলো টঙ্গি-ভৈরব বাজার-আখাউড়া মিটারগেজ ডাবল লাইন রেলপথকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেলপথে রূপান্তর। এতে ব্যয় হবে ১.৭১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১.৪৫২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে।
অপর প্রকল্প হলো লাকসাম-পাহাড়তলী মিটারগেজ ট্র্যাককে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকে রূপান্তর। ইআইবি ও এডিবি এই প্রকল্পে ৬০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের জন্য সম্মত আছে।
কমিউটার সার্ভিস
বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে ৭৫টি কমিউটার ট্রেন পরিচালনা করছে। আরও বেশ কমিউটার সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ভাঙ্গা, ঢাকা-ময়মনসিংহ, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড়ের ও খুলনা-মোংলার মতো উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রুটে কমিউটার ট্রেন সর্ভিস চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব উদ্যোগ
অবিলম্বে আয় বৃদ্ধির প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে যাত্রী ও ফ্রেইট ভাড়া পুনঃনির্ধারণ, চাহিদা অনুযায়িী অতিরিক্ত কোচ সংযোজন এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে আরও একটি বিরতিহীন ট্রেন চালু করা।
মেঘনা এক্সপ্রেসকে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ এবং ঢাকা-কক্সবাজার রুটে অতিরিক্ত ট্রেন চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
এছাড়া রেলওয়ের অপটিক্যাল ফাইবারের অব্যবহৃত অংশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লিজ দিয়ে আয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। রেলওয়ের অবৈধভাবে দখলকৃত ভূমি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে লিজ দেওয়া হবে।
এছাড়া যমুনা রেলসেতু চালু হওয়ায় পরিবহনকৃত মালামাল ঢাকার কাছাকাছি আনলোডিংয়ের জন্য টঙ্গী ও তেজগাঁও স্টেশনে আনলোডিং সুবিধাসংবলিত ইয়ার্ড তৈরি করা প্রয়োজন বলে রেলওয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ইয়ার্ড নির্মিত হলে রাজধানীর কাছে ফ্রেইট হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা উন্নত হবে।
মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা
মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, রেলপথ মন্ত্রণালয় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য—যেমন খাদ্যশস্য, সার ও জ্বালানি—রেলের মাধ্যমে পরিবহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায়, যাতে সরকারি লজিস্টিকস সুবিন্যস্ত এবং খরচ কমানো যায়।
মন্ত্রণালয় নীতিমালার সঙ্গে সংগতি রেখে ট্রেনের ভেতরে, প্রধান স্টেশনগুলোতে এবং রেলওয়ের মালিকানাধীন জমিতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে রেলওয়ের সম্পদ থেকে আয় করার বিষয়টিও বিবেচনা করছে।
আরেকটি প্রস্তাবিত সংস্কার হচ্ছে, ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। এটি ভাড়া ফাঁকি রোধ এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
টিকিটবিহীন ভ্রমণ ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে কঠোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে—বিশেষত অননুমোদিত প্রবেশ এবং বৈধ টিকিট ছাড়া যাত্রীদের প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হওয়া বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
যমুনা রেলসেতু চালু হওয়ায় ঢাকার কাছে পণ্য পরিবহন সহজতর করার জন্য টঙ্গী ও তেজগাঁওয়ে নতুন আনলোডিং ইয়ার্ড স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরাশ্রম ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মোংলা বন্দর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে কনটেইনার পরিবহনের লক্ষ্যে নিমতলীতে আইসিডি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বভন্দর দিয়ে আমদানিকৃত মালামালের প্রায় ৮০ শতাংশ ঢাকামুখী। ঢাকাসংলগ্ন মির্জাপুর/মৌচাক, নিমতলী, টঙ্গী, তেজগাঁও স্টেশনে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন পণ্য ইয়ার্ড প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া রেলওয়ের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে মার্কেট, আবাসিক হোটেল, অফিস স্পেস ইত্যাদি ভাড়া দিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির প্রস্তাবও করা হয়েছে।
রোলিং স্টক ও জনবল সংকট
সভায় রেলওয়ের কর্মকর্তারা বিদ্যমান লোকোমোটিভ, কোচ ও দক্ষ জনবল সংকটের কথা তুলে ধরেন।
কারখানা, শেড ও ক্যারেজ ডিপোগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা নির্মাণ করা হয়। নতুন ও আধুনিক রোলিং স্টক রেলবহরে যুক্ত হলেও কারখানা, শেড ও ডিপোর সক্ষমতা, কারখানা ও যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন হয়নি।
দেশব্যাপী চারটি লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ ও ৩৪টি ডিপো রয়েছে, তবে অনেকগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন।
এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়েতে মঞ্জুরিকৃত ৪৭ হাজার ৭০৩ জনবলের বিপরীতে মাত্র ২২ হাজার ৭৯০ জন (৪৭.৭৭ শতাংশ) জনবল কর্মরত রয়েছেন। এই ৫২ শতাংশ জনবল ঘাটতির কারণে ১৩০টি স্টেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছে এবং ট্রেন চলাচলে নিয়মিত ব্যাঘাত ঘটছে। জনবল নিয়োগের প্রচেষ্টা জোরদার করা হচ্ছে।