'রিয়েল লাইফ স্কুইড গেম': কিম সে-রনের মৃত্যু, কোরিয়ার সেলিব্রিটি সংস্কৃতির প্রকাশ!

অভিনেত্রী কিম সে-রনের আত্মহত্যার ঘটনায় দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন শিল্প নিয়ে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। দেশটির বিনোদন জগৎ একের পর এক তারকা তৈরি করলেও, শিল্পীদের তীব্র চাপ ও কঠোর নজরদারির মুখে ফেলছে। বিবিসি-এর একটি প্রতিবেদনে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন জগতের এ চিত্র উঠে এসেছে।
২৪ বছর বয়সী কিমকে গত রোববার সিউলে তার বাসায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ২০২২ সালে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি ব্যাপক নেতিবাচক সংবাদ ও অনলাইনে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার হন।
পুলিশ তার মৃত্যুর বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দুঃখজনকভাবে পরিচিত। এর আগেও অনেক তারকা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ক্যারিয়ারে সংকটের মুখে পড়ার পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
বুধবার কিমকে শেষ বিদায় জানানো হলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন, তার মৃত্যু থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে বলে তারা আশা করেন না।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিনোদন শিল্প বর্তমানে বিপুল জনপ্রিয়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কোরিয়ান বিনোদনের প্রায় ২২ কোটি ২০ লাখের বেশি ভক্ত রয়েছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার চার গুণ বেশি।
তবে বিনোদন জগতের কম আকর্ষণীয় দিকগুলোর ওপরও এখন বাড়তি নজর পড়তে শুরু করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া সাধারণত প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতির জন্য পরিচিত, যা শিক্ষা থেকে কর্মজীবন জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রেই বিদ্যমান। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ। যদিও সামগ্রিক আত্মহত্যার হার কমছে, তবে ২০-এর ঘরে থাকা তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে।
এই চাপ তারকাদের ক্ষেত্রে আরও তীব্র। তাদের মধ্যে নিখুঁত থাকার অসীম চাপ সহ্য করতে হয় এবং তারা এমন কিছু উন্মদ 'সুপার ফ্যানদের' চাহিদার মুখে পড়ে, যারা চাইলে একজন তারকার ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে বা ধ্বংস করে দিতে পারে।
এ কারণেই সামান্যতম ভুল বা বিতর্কিত ঘটনা অনেক সময় ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে। কিম সে-রন এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন যে, নেটফ্লিক্সের ২০২৩ সালের ড্রামা ব্লাডহাউন্ডস-সহ বিভিন্ন শো থেকে তার উপস্থিতি এডিট করে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
কোরীয় সংস্কৃতি সমালোচক কিম হের্ন-সিক বিবিসিকে বলেন, "শুধু আইনের শাস্তি তারকাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাদেরকে বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হতে হয়।"
তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০১৯ সালে কেপপ তারকা সুলি ও গুচ হারা আত্মহত্যা করেছিলেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে ট্রলের শিকার হয়েছেন। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি অভিযোগ ছিল না।
সুলি কেপপ তারকাদের প্রচলিত ছাঁচের বাইরে গিয়ে ভক্তদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, আর গুচ হারাকে তার সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে অনলাইন হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল।
'এটি বাস্তব জীবনের স্কুইড গেম'
সাইবার বুলিং এখন অনেকের জন্য অর্থ উপার্জনের উপায় হয়ে উঠেছে, বিবিসিকে বলেন কিম হের্ন-সিক।
তিনি বলেন, "ইউটিউবাররা ভিউ পাচ্ছেন, ফোরামগুলো এনগেজমেন্ট পাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমগুলো টপিক পাচ্ছে। আমি মনে করি না যে কিমের মৃত্যুতে এ পরিস্থিতি বদলাবে।"
তিনি বলেন, "নোংরা মন্তব্যের জন্য কঠোর অপরাধমূলক শাস্তির প্রয়োজন।"
কিম সে-রনের বাবা তার মৃত্যুর জন্য এক ইউটিউবারকে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেন, ওই ইউটিউবারের প্রকাশিত বিতর্কিত ভিডিওগুলো তার মেয়েকে গভীর মানসিক কষ্টে ফেলেছিল।
অনেকে কিছু স্থানীয় গণমাধ্যমকেও দায়ী করেছেন, যারা যাচাই-বাছাই ছাড়া অভিযোগ প্রচার করে কিমের বিরুদ্ধে জনমনে বিরূপ ধারণা তৈরি করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নাগরিক সংগঠন সিটিজেনস কোলিশন ফর ডেমোক্রেটিক মিডিয়া গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "এই গণমাধ্যম-চালিত চরিত্র হত্যার চক্র বন্ধ করতে হবে।"
ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক না জং-হো দক্ষিণ কোরিয়ায় একের পর এক তারকার মৃত্যুর ঘটনাকে বাস্তব জীবনের স্কুইড গেম-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। নেটফ্লিক্সের এই জনপ্রিয় কোরিয়ান সিরিজে ঋণগ্রস্ত প্রতিযোগীরা বিপুল অর্থ জেতার জন্য জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে নামে।
না জং-হো তার ফেসবুকে লিখেছেন, "আমাদের সমাজে যারা পথ হারায় তাদের পরিত্যাগ করে এবং কিছুই ঘটেনি এমন ভান করে এগিয়ে যায়। আর কত প্রাণ হারালে আমরা এই বিধ্বংসী, দমবন্ধ করা লজ্জা চাপিয়ে দেওয়া বন্ধ করব?"
তিনি আরও বলেন, "মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো অবশ্যই একটি বড় ভুল। যদি এটি শাস্তি ছাড়াই থেকে যায়, তাহলে আমাদের আইনি ব্যবস্থার ত্রুটি রয়েছে। তবে যারা ভুল করে তাদের দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে সমাজ যদি তাদের পুরোপুরি মাটিচাপা দিয়ে দেয়, তবে তা সুস্থ সমাজ নয়।"
গত বছর, বিবিসি একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরে যে কীভাবে কে পপ জগতের 'সুপার ফ্যানরা' তাদের পছন্দের তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। রোমান্টিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে কাজের বাইরের দৈনন্দিন কার্যকলাপ পর্যন্ত এবং কোনো কিছু তাদের প্রত্যাশার বাইরে গেলে তা ক্ষমা করতে নারাজ।
তাই ২০২৩ সালের এপ্রিলে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর (ডিইউআই) দায়ে ২ কোটি ওয়ান (১১ হাজার পাউন্ড) জরিমানা হওয়ার পর কিম সে-রনের জনসম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়।
তবে, এটি লক্ষণীয় যে, সব পাবলিক ফিগার একই ধরনের আচরণের শিকার হন না। রাজনীতিবিদরা, যার মধ্যে বিরোধী নেতা লি জে-মিয়াংও রয়েছেন, তাদেরও অতীতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর (ডিইউআই) অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তারা ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। পোলস থেকে জানা যায় যে, লি এখন দেশের শীর্ষ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।
দক্ষিণ কোরিয়ায়, কে পপ কলামিস্ট জেফ বেনজামিন বলেন, "শিল্পীদের জন্য এটি অত্যন্ত কঠিন যখন তারা এমন কিছু করেন যা তাদের 'আইডল' ইমেজে ছেদ ফেলে।"
তিনি একে পশ্চিমা বিনোদন শিল্পগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে বিতর্ক এবং কেলেঙ্কারি কখনও কখনও সেলিব্রিটির খ্যাতিতে এমনকি রকস্টারের পর্যায়ে নিয়ে যায়।"
তিনি বলেন, "যদিও কেউ খুশি হয় না যখন হলিউড সেলিব্রিটি ডিইউআই (মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো) এর জন্য আটক হন বা বড় অপরাধের জন্য কারাগারে যান, তবুও এটি স্বাভাবিকভাবে ক্যারিয়ার-শেষকারী হওয়া উচিত নয়।"
যদিও কোরিয়ান বিনোদন শিল্প কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য উদ্বেগ মোকাবেলা করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে এই পদক্ষেপগুলি কতটা কার্যকর হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
প্রকৃত পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন এই ধরনের অনুপ্রবেশকারী প্রতিবেদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর কোনও আর্থিক বা মনোযোগের প্রণোদনা না থাকে, বলে জানান বেঞ্জামিন।