‘না খেয়ে মরব, তবু কোম্পানির লোকদের হাত থেকে এক গ্লাস পানিও নেব না’

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে একটি রাবার কোম্পানি জুমভূমি পুড়িয়ে দেওয়ায় সেখানে খাদ্য সংকটে পড়া লোকজনকে উপজেলা প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী প্রদানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু রাবার কোম্পানির লোকজন উপস্থিত থাকায় সে ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে তিন পাড়াবাসী।
রোববার সকালে লামা ইউএনও মোস্তফা জাবেদ কায়সার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পর সেগুলো আবার ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাড়াবাসীরা।
লাংকম ম্রো পাড়ার বাসিন্দা যোহন ম্রো বলেন, 'রোববার সকালে উপজেলা প্রশাসন প্রথমে জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ার সবাইকে ত্রাণ বিতরণ করে। সেখানে মহসিন নামে লামা রাবার কোম্পানির একজন কর্মী ছিল। ত্রাণ বিতরণ করার সময়ও সে বারবার সহযোগিতা করছিল। পরে পাড়াবাসীরা জানার পর সবাই ত্রাণগুলো ফেরত দিয়ে দিই।'
'যারা এত বিশাল এলাকা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে তারাই আবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত থাকবে! এই রাগে ও ক্ষোভে কিভাবে ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করব আমরা! ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে চাল, মসুরি ডাল, মুড়ি ও দুই লিটার মিনারেল ওয়াটার ছিল', বলেন তিনি।
গত ২৬ এপ্রিল বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ৩০০-৩৫০ একর জুমভূমি, বাগান ও প্রাকৃতিক বনে একটি রাবার কোম্পানি আগুনে পুড়ে যায়। এরপর থেকে সেখানে খাবার সংকটে পড়ে আধপেটে দিন কাটছে লাংকম ম্রো পাড়া, রেংয়াং ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসীর। বন থেকে সংগ্রহ করা জংলি আলু, কলার নরম অংশ বুগলি, বিভিন্ন লতাপাতা ও শাকসবজি খেয়ে দিনাতিপাত করছেন তিন পাড়ার মোট ৩৬টি পরিবারের লোকজন।
যদিও লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন দাবি করেছেন, 'কোম্পানি লিজের ৪০০ একর জায়গার মধ্যে রাবার চারা ও কাজু বাদাম লাগানোর জন্য জঙ্গল কেটে আগুন লাগানো হয়েছিল। এতে পাড়াবাসীর কারও ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সবার ঘর অক্ষতই আছে।'
লাংকম ম্রো পাড়া কারবারি (পাড়াপ্রধান) লাংকম ম্রো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'না খেয়ে মরতেও রাজি আছি কিন্তু কোম্পানির লোকের হাতে ত্রাণ গ্রহণ করব না। রাবার কোম্পানির লোকদের হাত থেকে এক গ্লাস পানিও নেবো না। জঙ্গলের লতাপাতা খেয়েই থাকব।'
রেংয়াং ম্রো পাড়ার কারবারি রেংয়াং ম্রো বলেন, 'রাবার কোম্পানির লোকজনের উপস্থিতিতে আমরা কোন ত্রাণসামগ্রী নেবো না। তারা ব্যতীত অন্য যে কেউ আসলে এক পোয়া চাল হলেও নেব। কোম্পানির লোকজন এক পরিবারকে দশ বস্তা চাল দিলেও গ্রহণ করতে পারব না। আগুন জ্বালিয়ে যে ভোগান্তি ও কষ্ট দিয়েছে এত সহজে তা কিভাবে ভুলব!'
ত্রাণ বিতরণকালে রাবার কোম্পানির কর্মী হিসেবে তাকে কিভাবে চিহ্নিত করলেন প্রশ্নের জবাবে রেংয়াং ম্রো কারবারি অভিযোগ করে বলেন, 'আগুন লাগিয়ে দেওয়ার সময় তিনিও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিভিন্ন সময় এলাকায় লামা রাবার কোম্পানির লোকজনের সাথে তাকে বারবার দেখা গেছে।'
রেংয়াং ম্রো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে আরও বলেন, 'রোববার সকালে পাড়ায় লামা থানা থেকেও তদন্তের কাজে দুজন পুলিশ সদস্য আসেন। সবার ঘরে উঠে খাবার আছে কিনা ছবি তুলে নিয়ে যায়।'
শনিবার কক্সবাজারের রামু থেকে রাজেন্দ্র দেবনাথ ও শিপ্তা বড়ুয়া নামে দুই ব্যক্তির বিকাশে পাঠানো টাকায় সবাই দুই কেজি চাল পেয়েছিল। সে চাল রান্না করে খেয়ে রোববার দিন পার করেছেন বলে জানিয়েছে খাদ্য সংকটে পড়া এই তিন পাড়াবাসী।
লামা উপজেলা ইউএনও মোস্তফা জাবেদ কায়সার জানান, 'প্রথমে জয়চন্দ্র পাড়ার ১৬টি পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়। এরপর লাংকম ম্রো পাড়ায় ত্রাণ দিতে গেলে তারা ফেরত দেয়। এসময় জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসীরাও ত্রাণসামগ্রী ফেরত দিয়ে দেয়। পরে বুঝতে পারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সময় রাবার কোম্পানির লোক উপস্থিত ছিল।'
'সেখান থেকে রাবার কোম্পানির লোকজনকে সরিয়ে দেওয়ার পরও ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। এটা কেন হয়েছে বুঝতে পারছি না। ত্রাণগুলো সরই ইউনিয়ন পরিষদে রেখে দেওয়া হয়েছে। তারা চাইলে যে কোন সময় সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে', যোগ করেন তিনি।