ছয় মাসে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করেছে দুদক

আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রভাবশালী প্রায় দুই শতাধিক এমপি, মন্ত্রী, আমলা, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ছয় মাসে এসব প্রভাবশালীদের দেশে-বিদেশে থাকা প্রায় ১০,৪৭৫.৮৬ কোটি টাকার সম্পদ আদালতের নির্দেশে ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মধ্যে মোট ৭৬৫.৭৫ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৬৯০.৮১ কোটি টাকার ১৯১ একর জমি। এছাড়া ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ৬টি দোকান, ২৩টি গাড়ি, একটি ট্রাক, ৩টি জাহাজ, ৩টি কোম্পানি ও ৫২টি বাণিজ্যিক সংগঠন ক্রোক করা হয়েছে।
এছাড়া, এসব প্রভাবশালীদের দেশে থাকা মোট ৯৫৪৪.৫০ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৮৭১৩.৭৬ কোটি টাকার শেয়ার এবং ১০৩০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ৮১৭.১৪ কোটি টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সঞ্চয়পত্র, নগদ অর্থ, স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিও হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক।
বিদেশের সম্পদ জব্দ
দুদক জানায়, ক্রোক ও অবরুদ্ধের এ তথ্য আগস্টের পর থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এই সময়ে মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীদের বিদেশে থাকা ১৬৫.৬১ কোটি টাকার সম্পদও ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। শুধু বিদেশেই তাদের মালিকানায় থাকা ৫৮২টি ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন দেশে ২৩টি কোম্পানির অধীনে বিনিয়োগ করা ৮.৮৮ লাখ ডলার এবং ৮৬.২০ লাখ ইউরো অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব ফ্ল্যাট ও নগদ অর্থের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২০.৪৪ কোটি টাকা।
এছাড়া বিদেশের ব্যাংকে থাকা ৭.১৩ লাখ ডলার ও ২৮.৬৯ লাখ ইউরো ব্যাংক স্থিতি এ পর্যন্ত অবরুদ্ধ করা হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় যার আর্থিক মূল্য ৪৫.১৭ কোটি টাকা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের দিকে নজর
দুদক কর্মকর্তারা জানান, এ পর্যন্ত ক্রোক ও অবরুদ্ধ হওয়া এসব সম্পদের সিংহভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় রয়েছে।
যেমন—বিদেশে ক্রোক হওয়া ৫৮২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৫৮০টিরই মালিকানা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের।
এছাড়া, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ, সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোক করা হয়েছে।
এছাড়াও, এ পর্যন্ত বিতর্কিত ব্যাবসায়ী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম, পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদারসহ তাদের পরিবার ও আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যাবসায়ীদের সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ হয়েছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যৌথ প্রচেষ্টা
দেশে-বিদেশের অবৈধ এসব সম্পদ চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেয় দুদক।
এ পর্যন্ত অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়ায় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। একইসঙ্গে আদালতের আদেশের মাধ্যমে তাদের সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগস্টের পর অনেক প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকের সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধের জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করেন।"
আইনি প্রক্রিয়া ও এর ভবিষ্যৎ
ক্রোক ও অবরুদ্ধের পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের একজন আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "ক্রোক বা ফ্রিজ করার অর্থ হচ্ছে এসব সম্পদ হস্তান্তর কিংবা রূপান্তর করা যাবে না। অর্থাৎ, সরকার ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া।"
"এরপর সরকার চাইলে সেখানে রিসিভার নিয়োগ করে আয়-ব্যয় হিসাব রাখতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে। এরপর তাদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে মামলা হবে। পরবর্তীতে বিচারের মাধ্যমে আদালত নির্দেশ দিলে এসব সম্পদ বাজেযাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে আসামির শাস্তি হবে," যোগ করেন তিনি।
তবে এ প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ বলে জানান এ আইনজীবী।
দ্রুত বিচারের আহ্বান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জোর দিয়ে বলেন, যদিও প্রক্রিয়াটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ, বিশেষ করে বিদেশি সম্পদের ক্ষেত্রে–এরপরেও দুদককে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
"ক্ষমতায় থাকাকালীন দুর্নীতিতে জড়িতদের শেষ পর্যন্ত জবাবদিহি করতে হবে, এমন একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়ার জন্য বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে," বলেন তিনি।