একটা পলাতক দল সর্বাত্মক চেষ্টা করছে আনসেটেল করার জন্য: বিবিসি বাংলাকে ড. ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সাত মাসের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বিবিসি বাংলাকে দেওয়া একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার, নির্বাচন, ছাত্র নেতৃত্বের মাধ্যমে নতুন দল গঠনসহ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি নিয়ে তার অবস্থান তুলে ধরেছেন এই সাক্ষাৎকারে।
বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন।
পাঠকদের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো।
বিবিসি বাংলা: সর্বশেষ যখন আপনার সাথে আমার কথা হচ্ছিল ঠিক এক বছর আগে, এর মধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। আপনি তখন একটি গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন, আপনি বলেছিলেন গ্রেপ্তার আতঙ্কের কথা। সেখান থেকে আপনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন, যার ছয় মাস পার হয়ে গেছে। এই ছয় মাসকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনি যা করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, তাতে কতটা সফল হয়েছেন?
প্রধান উপদেষ্টা: প্রথমেই একটা সংশোধনী বলি, গ্রেপ্তার আতঙ্ক – আমার কাছে কোনো আতঙ্ক ছিল না। এটা ছিল একটি সম্ভাবনা যে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি তা সহজভাবে নিয়েছিলাম, বলেছিলাম 'নিলে নেবে, আমার তো করার কিছু নেই'। যেহেতু দেশে আইনকানুন নেই, কাজেই তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে। আমার জীবন তখন সে ভাবেই চলছিল। সরকার যখন গঠন হলো, আমার কোনো চিন্তা ছিল না, ভাবনা ছিল না যে আমি হঠাৎ করে সরকারের প্রধান হবো, দায়িত্ব পাবো। এবং সেই দেশ এমন ছিল, যেখানে সব তছনছ হয়ে গেছে। কোনো কিছু আর ঠিকমতো কাজ করছে না। যা কিছু ছিল, সব ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হতো।
তাহলে আমার প্রথম চেষ্টা ছিল সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আসল চেহারাটা বের করে আনা, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করা। সেই চেষ্টাটার মধ্যে ছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটার জন্য চিন্তা শুরু করি – কোনদিকে আমরা অগ্রসর হবো।
প্রথম চিন্তা আসে যে একটি সংস্কার প্রয়োজন আমাদের। কারণ যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী সরকার চলতে পেরেছে। ১৬ বছর ধরে চলেছে, আমরা কিছুই করতে পারিনি। তিনটি নির্বাচন হয়ে গেছে, কিন্তু ভোটারের কোনো দেখা নেই। এই যে অসংখ্য রকমের দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা, মিসরুল ইত্যাদি – সেখান থেকে আমরা কীভাবে বের করে আনবো? টেনে বের করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো করতে হবে। সেজন্য প্রথমে আমরা ঠিক করলাম...
বিবিসি বাংলা: কতটা টেনে বের করতে পেরেছেন বলে মনে হয় আপনার কাছে?
প্রধান উপদেষ্টা: সংস্কারের বিষয়ে? সংস্কার তো এখনও শুরু করিনি...
বিবিসি বাংলা: না, যে বিষয়ে আপনি বলছিলেন, যখন প্রধান উপদেষ্টা হলেন তখন এক ধরনের পরিস্থিতি ছিল...
প্রধান উপদেষ্টা: অনেক পরিবর্তন...
বিবিসি বাংলা: কতটা পরিবর্তন? আপনার চোখে কী মনে হয়?
প্রধান উপদেষ্টা: বহু পরিবর্তন। এটা আমি বলবো, যে ধ্বংসাবশেষ থেকে এসেছিলাম, তার নতুন চেহারা আসছে। ভেসে উঠছে যে, আমরা অর্থনীতি সহজ করেছি। দেশ-বিদেশের আস্থা অর্জন করেছি। এটাতো পরিষ্কার – সারা দুনিয়ায় আমরা আস্থা স্থাপন করতে পেরেছি। এটা কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না যে আমি অমুক দেশের আস্থা অর্জন করতে পারিনি। যে দেশেই বলুন, তারা আমাদের উপর আস্থা স্থাপন করেছে। শুধু আস্থা স্থাপন করেছে না, বিপুলভাবে করেছে। তারা বলছে, আমরা অতীতে যা করি নাই তারচেয়ে বেশি করবো এখন, যেহেতু আমরা দেখছি যে সুন্দরভাবে সরকার চলছে এখন। সেইজন্য তারা বলছে। কাজেই এটা একটা বড় প্রমাণ। যখনই আপনি দেশের সারিগুলো দেখবেন, প্রত্যেকটা দেশ নিজে এসে বলেছে, 'আমরা তোমাদের সমর্থন করছি। তোমাদের যা দরকার, আমরা দেবো'। অবিশ্বাস্য রকমের সহায়তা দিয়েছে তারা।
বিবিসি বাংলা: বিদেশে আপনি আস্থা ও সমর্থনের কথা বলছেন, তবে যদি দেশের প্রসঙ্গে আসি—আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে আসি। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। আর যদি পুলিশের এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান দেখি, তবে অপরাধের পরিমাণ কিন্তু বেশ কিছুটা বেড়েছে। তাহলে, এটা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না আপনারা?
প্রধান উপদেষ্টা: আস্থার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আস্থার কথাতেই ফিরে যাই, দেশ-বিদেশের আস্থা। দেশের মানুষের আস্থা আমাদের উপর আছে কিনা, এটাই তো বড় কথা।
আমার মনে হয়, দেশের মানুষের আস্থা আমাদের উপর আছে। বিপুল পরিমাণে আছে। কাজেই, সেটাই বড় প্রমাণ। আমরা কী করছি বা কী করছি না—এগুলো খুচরো বিষয়। আমাদের খুচরো বিষয়গুলোর মধ্যে কিছু ভালো, কিছু মন্দ—এটা হতে থাকবে। এটা একটা অপরিচিত জগৎ, আমরা এসেছি। আমরা কোনো এক্সপার্ট হয়ে এখানে এসে বসি নি। আমরা এসেছি, যার যার জগৎ থেকে এসেছি, নিজের মতো করে চেষ্টা করছি কীভাবে করতে পারি। এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। কিছু ভালো করেছি, কিছু ভালো করতে পারিনি। এটা হতে পারে, আমি তো অস্বীকার করছি না।
বিবিসি বাংলা: ভালো হয়নি কোনটা আপনার চোখে?
প্রধান উপদেষ্টা: কোনোটাই ভালো হয়নি, সে অর্থে। যতটুকু ইচ্ছা আমাদের—আমাদের ইচ্ছা তো অনেক। রাতারাতি দেশ পরিবর্তন করতে চাই, কিন্তু সেটি তো আমরা পারিনি। সময় লাগবে।
আমরা চেয়েছিলাম যে, এখনই আমরা সংলাপ শুরু করবো, কিন্তু এটাও পারিনি। সংলাপ শুরু হতে হতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এগুলো আর কী। যেগুলো সময়মতো আমরা করতে চেয়েছি, সে সময়টাতে করতে পারিনি।
আমরা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছি। আমাদের ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা দিতে পারেনি। আমি অভিযোগ করছি না, কারণ এটি বিশাল কাজ। তারা আরও কিছু সময় চেয়েছে—এক মাস, দুই মাস। ওইটুকু একটু পিছিয়ে গেছে। এগুলো আর কী। কাজ করতে গেলে যা হয়।
'অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি'
বিবিসি বাংলা: আপনি সংস্কারের কথা বলছিলেন, আমরা যদি আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ফিরে আসি, পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, অনেকেই বলছেন যে তারা নানা রকম ভয়ে আছেন, আতঙ্কে আছেন – যেহেতু অপরাধটা তারা দেখছেন, রাস্তাঘাটে যেটা হচ্ছে। এটা আপনারা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?
প্রধান উপদেষ্টা: অবনতিটা কোন পয়েন্ট থেকে হয়েছে? এটা বলতে হবেতো আমাকে। আপনি বলছেন অবনতি হয়েছে। কোন রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে অবনতিটা হয়েছে? সেটা না দিলেতো আমরা বুঝতে পারবো না।
বিবিসি বাংলা: আমি যদি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের কথা বলি, গত বছর এই সময় থেকে অপরাধের পরিমাণ রাস্তাঘাটে যেমন...
প্রধান উপদেষ্টা: আমিতো হিসাব নিচ্ছি। অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। আগের মতোই হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: আমি যদি একটা পরিসংখ্যান আপনাকে দিই, গত ছয় মাসে...
প্রধান উপদেষ্টা: একটা দিয়েতো আর বিচার হবে না; সমস্ত কিছু নিয়ে আসতে হবে।
বিবিসি বাংলা: ছয় মাসে ডাকাতির সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এটা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী। সেটা আমি বলছি। হয়ত পরিসংখ্যান বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এটা আছে এবং হচ্ছে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?
প্রধান উপদেষ্টা: চেষ্টা করছি আমরা। সমস্যা আপনিও জানেন, আমিও জানি। প্রথম দিকে সমস্যা ছিল যে পুলিশ বাহিনী যাকে দিয়ে আমরা কাজ করাচ্ছিলাম, তারা ভয়ে রাস্তায় নামছিল না। দুইদিন আগে তারা এদেরকে গুলি করেছে। কাজেই মানুষ দেখলেই সে ভয় পায়। কাজেই তাকে ঠিক করতে করতেই আমাদের কয়েক মাস চলে গেছে। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। এখন আবার নিয়মশৃঙ্খলার দিকে আমরা রওনা হয়েছি। কাজ করতে থাকবো।
বিবিসি বাংলা: সেই অপরাধের পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, যেটাকে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বলা হচ্ছে। যেমন গণপিটুনির একটা বিষয় দেখা গেছে। কিছুদিন আগের কথা যদি বলি, ধানমন্ডি ৩২সহ সারাদেশে অনেক ভবনে ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে এগুলো চললেও সরকারের কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। তখন কেন তেমন ভূমিকা দেখা গেল না? আপনি পরে এটা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন কেন কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি?
প্রধান উপদেষ্টা: সময় নিচ্ছে। তারা প্রস্তুত হয়ে নিয়ে তাদের মানসিকতা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। এটা একটা জিনিস হতে পারে। আরেকটা হলো যে আমরা তাদের বলেছি, যেকোনো পুলিশ স্টেশনে তারা যেকোনো রিপোর্ট করতে পারে। আইনের আশ্রয় নিতে পারে এবং সেটাকে আমরা সহজ করেছি এখন। বলছি তোমরা ইন্টারনেটে দিয়ে দিতে পারো, অনলাইন পেইজ করতে পারো। যাতে মামলা করতে গিয়ে, হয়রানি হয় – বরাবরই বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য, থানাতে গেলে যে সমস্ত হয়রানি হয়, সেটা থেকে বাঁচার জন্য যেন অনলাইন করে। সেই অনলাইনের ব্যবস্থা করছে। যা যা আমাদের মনে হয়েছে যে মানুষকে সহজ করা যাবে, তাদের তথ্য আদান-প্রদান সহজ করা যাবে এবং মামলা করা সহজ করা যাবে, ইত্যাদি।
বিবিসি বাংলা: অনলাইনে তারা করতে পারছেন, সেটা আপনারা সহজ করেছেন কিন্তু আসল কাজটাতো পুলিশকে করতে হবে। আপনি যে বলছেন পুলিশ সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি, তারা নিজেরা আস্থা পাচ্ছে না বা তারা সেভাবে সক্রিয় হচ্ছে না। প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে, এখনও তাদের আস্থার সংকটটা দূর করা গেল না?
প্রধান উপদেষ্টা: এখনও সম্ভব হয়নি। তবে চেষ্টা করছি। অনেক ইমপ্রুভ হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
ঐক্যের মধ্যে ফাটল?
বিবিসি বাংলা: আপনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গে আসি। আপনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তার আগে যে আলোচনা হয়েছিল, সেখানে তিনটি পক্ষকে সক্রিয় দেখা গিয়েছিল। একটি হচ্ছে সেই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা, রাজনৈতিক দলগুলো এবং তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে সেনাবাহিনী। এই তিন পক্ষের সবাই আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তখন আপনার অন্তর্বর্তী সরকারের যে সম্পর্ক ছিল, এখনও কি সেটা আছে? নাকি এখন সেই অবস্থা আর নেই?
প্রধান উপদেষ্টা: আমার তো অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। কেউ আমাকে অসমর্থন করছে, এমন কোনো খবর তো আমি পাইনি এখনও। সবাই সমর্থন করছে, সবাই চাচ্ছে যে সুন্দরভাবে দেশ চলুক, তাদের সবার মধ্যে ঐক্য আছে।
রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে অনেক তফাত আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরেছে। এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
বিবিসি বাংলা: আমি যদি একজনের কথা বলি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি বক্তব্যে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা: জনমনে... ওনার মনে সন্দেহ হয়েছে কিনা, এটা হলো কথা।
বিবিসি বাংলা: তাদের মনে কেন সন্দেহ তৈরি হবে?
প্রধান উপদেষ্টা: সে করেনি তো। সে কথাই বলছি। আমরা যখন বসি, কেউ তো বলে নাই যে সন্দেহ হচ্ছে। সে বলছে আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
বিবিসি বাংলা: মানে আপনাদের সামনে ভিন্ন কথা বলছে, কিন্তু বক্তব্যে ভিন্ন কথা বলছে। তাই কি হচ্ছে?
প্রধান উপদেষ্টা: ভিন্ন বলছে কিনা, সেটা আপনারা বোঝেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো ঘাটতি হয়নি।
বিবিসি বাংলা: ছাত্রদের প্রসঙ্গে... ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। বা এরই মধ্যে করে ফেলেছে। সে বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে সরকার তাদের সহায়তা করছে। সরকার কি সহায়তা করছে তাদেরকে বা করেছে?
প্রধান উপদেষ্টা: না, সরকার কোনো সহায়তা করে না। যে রাজনীতি করতে চায়, সে নিজেই ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে। তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি ছিল সরকারের ভেতরে। যিনি রাজনীতি করতে মনস্থির করেছেন, তিনি ইস্তফা দিয়ে সরকার থেকে চলে গেছেন। তিনি প্রাইভেট সিটিজেনশিপে রাজনীতি করবেন, কার বাধা দেওয়ার কী আছে?
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে এবং পরে বিভিন্ন সময় বলেছেন যে ছাত্ররাই আপনার বা আপনাদের নিয়োগকর্তা। সে কারণেই কি তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সরকারের সমর্থন আছে?
প্রধান উপদেষ্টা: দেখুন তো এখনও। দেখলে না ঠিক করবো যে ওদের কাজকর্ম ভালো হচ্ছে কিনা। প্রত্যেকের তো মনোভাব থাকবে যে ওই রাজনৈতিক দলটা সুন্দর কাজ করছে, ওই রাজনৈতিক দলটা ঠিক কাজ করছে না। এটা মনোভাব হতে পারে ব্যক্তিগতভাবে। সরকার হিসেবে আমাদের কোনো পজিশন নেই।
বিবিসি বাংলা: তাহলে আপনি কি বলবেন যে অভিযোগটা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেটা সঠিক নয়?
প্রধান উপদেষ্টা: সঠিক নয় মোটেই।
সেনাবাহিনী কী সহযোগিতা করছে?
বিবিসি বাংলা: সেনাবাহিনী থেকে কি আপনি সহযোগিতা পাচ্ছেন?
প্রধান উপদেষ্টা: সর্বাত্মকভাবে।
বিবিসি বাংলা: প্রথম থেকে যা ছিল, এখনও তাই?
প্রধান উপদেষ্টা: এবসুলেটলি।
বিবিসি বাংলা: আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে সম্প্রতি সেনাপ্রধান একটি বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন, অনেক বিষয়ে তিনি এবং আপনি একমত। তার মধ্যে একটি বক্তব্য ছিল যে, সবাই একসাথে কাজ করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে বা বিপন্ন হতে পারে। আপনি কি এই বক্তব্যের সাথে একমত?
প্রধান উপদেষ্টা: এটা উনার বক্তব্য, উনি বলবেন। আমার ওনাকে এনডোর্স করা না করার বিষয় না।
বিবিসি বাংলা: যেহেতু উনি বলেছেন অনেক বিষয়ে কথা হয়, আপনি অনেক বিষয়ে একমত। অথবা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? সরকার প্রধান হিসেবে আপনি কী মনে করেন?
প্রধান উপদেষ্টা: এটাতো সবসময় থাকে। একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে আনসেটেল করার জন্য। এটা সবসময়ই একটা থ্রেট থাকে। প্রতি ক্ষণেই থাকে, প্রতি জায়গাতেই থাকে। কাজেই এটা সবসময় থাকবে।
বিবিসি বাংলা: হুমকিটা কি আপনি বলছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ থেকে?
প্রধান উপদেষ্টা: অবশ্যই। এটা তো অবভিয়াস। তারা মাঝে মাঝে ঘোষণা করছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, অ্যাড্রেস করছে। আপনি-আমরা সবাই শুনছি। মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে।
বিবিসি বাংলা: আওয়ামী লীগের বিষয়ে আপনারা বলেছেন বা আপনি এখন যেটা বললেন, তাদের দিক থেকে নানা কর্মকাণ্ড আছে। হুমকিটা কোথায়?
প্রধান উপদেষ্টা: এই যে অ্যাড্রেস করছে, জাগো, কাজে নামো ইত্যাদি, অনেক আহ্বান জানাচ্ছে, কর্মসূচি দিচ্ছে, হরতাল করো, অমুক করো। মানুষ কীভাবে নেবে এটাকে বলেন? এটা কি মিষ্টি মুখে চলে যাবে সব?
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বড় লক্ষ্য হিসেবে আপনি সংস্কারের কথা বলেছেন। এটি নিয়ে আপনি অনেকগুলো কমিশনও গঠন করেছেন। কিন্তু এখন যেহেতু আপনারাই বলছেন যে বছরের শেষে নির্বাচন হবে, তো এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনারা সংস্কার কতটা করতে পারবেন বলে মনে করেন?
প্রধান উপদেষ্টা: সেটা আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা একেবারে প্রত্যেকটা সুপারিশ দেবো। সুপারিশের সঙ্গে কথা থাকবে যে, আপনার রাজনৈতিক দল এটা কি সমর্থন করে? এতে রাজী আছেন? রাজী থাকলে বলেন, রাজী না থাকলে বলেন। অথবা এই সুপারিশটার মধ্যে কোনো একটা সংশোধনী এনে রাজী হবেন, সেটা বলেন। এটা কি নির্বাচনের আগে সংশোধন করা ঠিক হবে নাকি নির্বাচনের পরে – সব প্রশ্নের এখানেই সমাবেশ আছে।
রাজনৈতিক দলকে শুধু বলতে হবে কোনটা? সবকিছু মিলিয়ে আমরা এটা ঠিক করবো, কোন সুপারিশে সবাই একমত হয়েছে। সেটা আলাদা করবো, যে এটাতে সবাই একমত হয়েছে। এরকম যে সমস্ত সুপারিশে তারা একমত হয়েছে, সেগুলো আমরা আলাদা একটা কাগজে নিয়ে আসবো, যে এসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে এটাকে আমরা বলবো একটা চার্টার – জুলাই চার্টার।
এবং সবাইকে আহ্বান জানাবো, আপনারা সবাই যেহেতু একমত হয়েছেন, এটাতে সই করে দেন। জুলাই চার্টারের মতোই আমরা চলবো। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনটা হবে। নির্বাচনের আগে যেটা বলেছেন সেটা নির্বাচনের আগে হবে, যেটা নির্বাচনের পরে বলেছেন সেটা নির্বাচনের পরে হবে। এটা আপনারা ঠিক করবেন। কিন্তু আপনারা একমত হয়েছেন। সেই ঐকমত্যই আমরা গঠন করার চেষ্টা করছি।