দাম বাড়িয়েও ধান পায়নি সরকার, আমনে সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮.৭৫%

এ বছর আমনের দাম ৩ টাকা বাড়িয়েও সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮.৭৫ শতাংশ। গেল শুক্রবার ধান সংগ্রহের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর এমন চিত্র দেখা গেছে।
খোলা বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় এবং সংগ্রহ জটিলতা এড়াতে সরকারের কাছে এবার ধান বিক্রি করেননি কৃষকরা। এতে বরাবরের মতো এবারও ধান সংগ্রহে ভাটা পড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ নভেম্বর থেকে আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়। এ মৌসুমে ৩৩ টাকা দরে সাড়ে ৩ লাখ টন ধান, ৪৭ টাকা দরে সাড়ে ৫ লাখ টন সিদ্ধ চাল, আর ৪৬ টাকা দরে ১ লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে এবার ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৬,২৭৭ টন। এছাড়া, ৪,৩০,২০৬ টন চাল এবং ৭৭,০০০ টন আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে। তবে ধান ও চাল সংগ্রহের সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও আতপ চাল সংগ্রহ চলবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত।
গতবছর আমন মৌসুমে ধান, চাল ও আতপ চাল এ বছরের চেয়ে ৩ টাকা কমে যথাক্রমে ৩০ টাকা, ৪৪ টাকা ও ৪৩ টাকায় সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে এবার দাম বাড়িয়েও সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর।
কৃষকরা বলছেন, এ বছর আমন মৌসুমে উপযুক্ত আবহাওয়া না থাকায় এবং বন্যার কারণে ফলন ব্যাহত হয়েছে। যার কারণে বাজারে চালের চাহিদা বেশি ছিল। ফলে খোলা বাজারে দাম বেশি থাকায় সরকারিভাবে দাম বাড়ালেও তাতে সাড়া দেননি কৃষকরা।
এছাড়া সরকারি গুদামে ধান দিতে হলে বাড়তি পরিবহন খরচ ও নিয়মতান্ত্রিক জটিলতার চেয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তারা।
ঝিনাইদহের সদর উপজেলার কৃষক সোহেল রানা টিবিএসকে বলেন, "এবার ৪ বিঘা জমিতে আমন ধান করেছিলাম। বৃষ্টির কারণে ফলন পেয়েছি মাত্র ২০ মণ করে। এরপর ১,৩৫০ টাকা প্রতিমণ (কেজি ৩৪ টাকা) বিক্রি করে দিয়েছি। সরকারি গুদামে দিতে গেলে দাম কম, আবার পরিবহন খরচ ও জটিলতা আছে। একারণে দেইনি।"
একই কথা জানান নাটোরের সদর উপজেলার কৃষক বিশ্বজিৎ দেবনাথ। তিনি বলেন, "আমরা স্বর্ণা-৫ জাতের ধান বিক্রি করেছি ১,৪৮০ টাকা করে। সরকার নিলে দাম অনেক কম হতো। তাহলে কেন সরকারি গুদামে বিক্রি করবো?"
"তবে এবার ফলন কম হয়েছে। বিঘায় অন্তত ৫-৬ মণ ধান আগের চেয়ে কম হয়েছে। এ কারণে ধানের চাহিদা বেশি ছিল। মিলগুলো থেকে বেশি দামে কিনেছে," যোগ করেন এই কৃষক।
শুধু এবারই নয়, ধান সংগ্রহে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। গত বছরের আমন মৌসুমে ধান ১২ শতাংশ এবং চাল ৯৬.১৫ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ধান ১.৫৬ শতাংশ, চাল ৮৬.০২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান ২৮.১৬ শতাংশ এবং চাল ৯৮.৭৪ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছিল।
সরকারের মজুদ নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও আমদানির ওপর। আর মজুদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে গত অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি। এর পাশাপাশি বারবার অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ব্যর্থতার কারণে গত বছরের শেষদিকে মজুদ কমে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চালের দাম কেজিতে ৪–১০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যদিও এরপর সরকার আমদানিতে জোর দিলে চালের দাম কিছুটা স্থির হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রধান হাতিয়ার মজুদ ব্যবস্থাপনা। বাজারে অস্থিতিশীলতার মুহূর্তে সরকারি মজুদ থেকে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রির মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখার কৌশল প্রয়োগ করা হয়। আর ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে সরকারের। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পর্যাপ্ত সংগ্রহ না হলে তা চালের বাজারকে সামনে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর দিতে হয়। এরমধ্যে উৎপাদন কেমন হলো, সে অনুযায়ী আমদানি পরিকল্পনা ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহের মাধ্যমে মজুদ শক্তিশালী রাখা এবং মনিটরিং অন্যতম।"
তিনি বলেন, "আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক তথ্য। কারণ আমরা গবেষণা করতে গিয়ে দেখছি, সরকারের দেওয়া উৎপাদনের তথ্য বাস্তবের সাথে মেলে না। এর একটিতে ব্যঘাত ঘটলেই কিন্তু বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।"
যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ধান সংগ্রহের লক্ষ্য বরাবরই কিছুটা বেশি নির্ধারণ করা থাকে, যাতে কৃষক বাজার থেকে ন্যূনতম যৌক্তিক মূল্য তুলে নিতে পারেন। আর চাল সরবরাহ করেন মূলত মিলাররা। এজন্য চাল সংগ্রহের লক্ষ্যও বেশি ধরা হয়।