ফার্নেস তেল আমদানির সার্ভিস চার্জ কমায় আর্থিক চাপে পড়ার আশঙ্কা বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) আকস্মিকভাবে ফার্নেস তেল (এইচএফও) আমদানির ওপর সার্ভিস চার্জ ৯.০৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করায় স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা (আইপিপি) আর্থিক চাপে পড়ার পাশাপাশি গ্রীষ্মের আগে বিদ্যুৎ সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত উৎপাদনকারীদের কমপক্ষে ৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই অবস্থায় সার্ভিস চার্জ হ্রাস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি আমদানি সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা, যা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি কেএম রেজাউল হাসানাত এ সিদ্ধান্তকে 'খামখেয়ালি' হিসিবে অভিহিত করে বলেন, 'বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প খাত ও সেচ কার্যক্রমের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা না করেই পরামর্শ ছাড়াই এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পিডিবি এক চিঠিতে ৪৮টি এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে নতুন সার্ভিস চার্জ সম্পর্কে অবহিত করে এবং একে বিদ্যুৎ খাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয় নিয়ন্ত্রণের একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
তবে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য এই সিদ্ধান্ত বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিলম্বিত অর্থপ্রদান, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং উচ্চ করের চাপে ভুগছে।
৬ হাজার ৪৪২ মেগাওয়াট ইনস্টল সক্ষমতার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করেছেন, এগুলোর জন্য জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখা সম্ভব না হলে আগামী গ্রীষ্মে দেশকে আরও বড় বিদ্যুৎ সংকটের মুখে পড়তে হতে পারে।
হাসানাত বলেন, 'যদি সার্ভিস চার্জ নতুন হারেই নির্ধারিত থাকে, তবে আমরা জ্বালানি আমদানি করব না; বরং বিপিসি থেকে ভারী জ্বালানি তেল সংগ্রহ করব।'
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ ১ মার্চ টিবিএসকে বলেন, যদি স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে, তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) সরবরাহ নিশ্চিত করবে।
পিডিবির মতে, রমজান মাসেই বিদ্যুৎ ব্যবহারের চাহিদা ৪ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বাড়বে, ফলে পিক-টাইম বিদ্যুৎ চাহিদা বর্তমান ১১ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারে।
সার্ভিস চার্জ কাঠামো
পিডিবি এতদিন জ্বালানি তেলের মোট আমদানি মূল্যের ওপর ১১টি ক্যাটাগরিতে ৯.০৪ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করত। ২০১৬-১৭ সালের পর থেকে স্থাপিত এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য এই সুবিধা চালু ছিল।
১১টি ক্যাটাগরির মধ্যে রয়েছে — ভ্যাটসহ এলসি খোলার কমিশন (০.৫৮ শতাংশ), ভ্যাটসহ এলসি গ্রহণ কমিশন (১.১৫ শতাংশ), কনাফার্মেশন চার্জ (১.৩৬ শতাংশ), ৭৫ দিনের মধ্যে পেমেন্ট করলে ছাড় চার্জ (০.৯৬ শতাংশ), শুল্কের সুদ (১.২৪ শতাংশ), স্টোরেজ ভাড়া (১.৪৩ শতাংশ), সমুদ্রপথে ক্ষতি (০.৫০ শতাংশ), অভ্যন্তরীণ পরিবহনসহ হ্যান্ডলিং ক্ষতি (০.২০ শতাংশ), থ্রুপুট চার্জ (০.০৪ শতাংশ), বিআইডব্লিউটিএ ল্যান্ডিং চার্জ (০.০৪ শতাংশ), ডেমারেজ (০.৭৯ শতাংশ) এবং ওভারহেড (০.৭৫ শতাংশ)।
পিডিবি এই সার্ভিস চার্জ পর্যালোচনা করতে সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিশের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কমিটি চার্জ ৯.০৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের সুপারিশ করে, কারণ তারা দেখতে পায়, পূর্ববর্তী চার্জের মধ্যে অনেকগুলো এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়।
পিডিবি চেয়ারম্যানের বক্তব্য
বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী, স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ পর্যালোচনার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে।
পিডিবির ভাষ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা গত ১০ বছর ধরে এই সুবিধা ভোগ করে আসছেন। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে এই চার্জ পর্যালোচনা করছে।
পিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম ২৭ ফেব্রুয়ারি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের ভর্তুকি দিচ্ছি। ভর্তুকি কমাতে সরকার ব্যয় সংকোচনের বিভিন্ন উপায় খুঁজছে, যার মধ্যে সার্ভিস চার্জ কমানোর সিদ্ধান্তও রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কখনো কখনো এলসি খোলে কিন্তু নিজেরা জ্বালানি আমদানি না করে বিপিসি থেকে সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে তারা সার্ভিস চার্জ পাওয়ার যোগ্য নয়।'
সরকার বিপিসির মাধ্যমে এইচএফও সরবরাহের পরিকল্পনা করছে
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব, পিডিবির চেয়ারম্যান এবং বিপিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথোপকথনে টিবিএস জানতে পেরেছে, পরিষেবা চার্জ হ্রাসের প্রতিবাদে আইপিপিগুলো জ্বালানি আমদানি করতে অস্বীকৃতি জানালে সরকার বিপিসির মাধ্যমে এইচএফও সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে।
১ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বলেন, বিপিসি বিভাগকে আশ্বস্ত করেছে যে, আইপিপিগুলো যদি নতুন নির্ধারিত পরিষেবা চার্জের অধীনে জ্বালানি আমদানি করতে অনিচ্ছুক হয়, তবে তারা তাদের জ্বালানি সরবরাহ করবে।
আইপিপিগুলোর প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জ্বালানি সরবরাহের জন্য বিপিসির পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা আছে কি না — এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, বিপিসির আছে। তাদের একটি আমদানি লাইন রয়েছে এবং আইপিপিগুলোর চাহিদা থাকলে বিপিসি জ্বালানি সরবরাহের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে।'
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম জানান, এইচএফও আমদানি বাড়ানোর জন্য বিপিসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে আইপিপিগুলো তাদের কাছ থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারে।
বিপিসির সক্ষমতা কতটুকু?
বিপিসির জ্বালানি তেলের ধারণক্ষমতা ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। তবে জেটির ঘাটতির কারণে মাসে সর্বোচ্চ চারটি জ্বালানি তেলবাহী কার্গো পরিচালনা করা সম্ভব, যার প্রতিটির ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে, জ্বালানি খালাসের জন্য তিন-চারটি জেটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তবে বিপিসির মতে এটি অপর্যাপ্ত, যার ফলে জট সৃষ্টি হচ্ছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, 'আমাদের স্টোরেজ সক্ষমতা সীমিত। আমরা হাতে থাকা সক্ষমতার সঙ্গে আমাদের জ্বালানি আমদানি সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করছি। আমাদের বর্তমান স্টোরেজের কারণে আমরা একসঙ্গে সব আইপিপিগুলোকে সেবা দিতে পারব না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা জেটিতে জটের সম্মুখীন হই। আমরা তিন-চারটি জেটি ব্যবহার করি, যেগুলো দিয়ে বেশিরভাগ সময় পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন ও অপরিশোধিত তেল — এ ধরনের পণ্য পরিচালনা করা হয়। যদিও আমরা অতিরিক্ত এইচএফও-বোঝাই কার্গো আনতে ইচ্ছুক, জেটিতে জটের কারণে প্রায়শই তা ব্যাহত করে। জেটি ও স্টোরেজ ক্ষমতা বিবেচনা করে আমদের সর্বোচ্চ তিন থেকে চারটি কার্গো আনা সম্ভব, তার বেশি নয়।'
এইচএফও-এর চাহিদা
এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উচ্চ খরচের কারণে সারা বছর সচল থাকে না। শীতকালে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় বেশিরভাগ এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকে। সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সচল থাকে, বিশেষ করে গ্রীষ্মের মাসগুলোতে, যখন দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা থাকে।
এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি প্রয়োজন। পিডিবি মার্চ মাসের জন্য ৯০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানির চাহিদার অনুমান করেছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, 'আমাদের বর্তমানে ৭০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি মজুদ রয়েছে এবং মার্চ মাসে ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত ৭৫ হাজার মেট্রিক টন প্রস্তুত করা হয়েছে। আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল দুটি কার্গো আনা, তবে এখন আমরা পিডিবির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতিরিক্ত কার্গো আনছি।'
বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া পরিশোধ পরিস্থিতি
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিদ্যুৎ খাত বিলম্বিত ব্যয় পরিশোধের সংকটে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র মালিকদের পাওনা পরিশোধ কমিয়ে দেয়।
গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে ১৯ হাজার ৪৭৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে।
এর মধ্যে সরকারের কাছে এইচএফও-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৩ হাজার ৬৬২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ৬ হাজার ৪৫৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ২ হাজার ৫৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ৫ হাজার ৩১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য (আদানি বাদে) ১ হাজার ৯৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং সৌর-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৪০২ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
আইপিপিগুলোর অর্থ পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, 'সরকার মার্চ মাসের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আমরা এই অর্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করব।'