লাইটার জাহাজ সংকট: চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার জট বাড়ায় সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত

লাইটার জাহাজের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে। এ অবস্থায় ৪০০টিরও বেশি বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজ বন্দরের বহি:নোঙ্গরে অলস পড়ে থাকায় সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে।
এতে দেশের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে তীব্র কন্টেইনার জট, যা বন্দরের অপারেশনাল চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এতে আর্থিকভাবেও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, গতকাল (২৬ ফেরুয়ারি) জারি করা এক নির্দেশনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, বহি:নোঙ্গরে মাদার ভেসেল বা বড় জাহাজ থেকে পণ্য লোড করার পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই লাইটার জাহাজগুলোকে বন্দর সীমা ত্যাগ করতে হবে। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো মূলত আমদানিকারকরা যেন কৃত্রিমভাবে সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পণ্যের দাম বাড়তে না পারেন, তা নিশ্চিত করা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটর (ডিসি) ক্যাপ্টেন ফরিদুল আলম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে জনস্বার্থে এই আদেশ জারি করা হলো। ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা মানতে কেউ ব্যর্থ হলে চট্টগ্রাম বন্দর আইন এবং আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বন্দর সুবিধা সুরক্ষা (আইএসপিএস) কোডের অধীনে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিত।
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ব্যক্তি মালিকানাধীন পণ্যবাহী লাইটার জাহাজ, অয়েল ট্যাংকার এবং শিল্প মালিকদের লাইটার জাহাজসহ মোট ৩ হাজার লাইটার জাহাজ, ট্যাংকার চলাচল করে। এরমধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন লাইটার জাহাজের সংখ্যা প্রায় ১৮০০টি। এই জাহাজগুলোই মূলত ভাসমান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেন আমদানিকারকরা।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, "বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্যই এসব পন্থা অবলম্বন করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। যে কারণে বাজারে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়ে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।"
তিনি বলেন, "বাজারে যাতে সরবরাহ সংকট তৈরি না হয়, তা মনিটরিংয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।"
বহি:নোঙ্গরে একটি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসের জন্য দৈনিক ৩টি লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হতো। এখন সেটি নেমে এসেছে একটি বা তিনদিনে সর্বোচ্চ দুটিতে। দৈনিক লাইটার জাহাজের বরাদ্দও কমে গেছে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য মতে, আকার ভেদে ১,২০০ মেট্রিক টন থেকে ৫,০০০ মেট্রিক টন পণ্য বহন করে লাইটার জাহাজ। প্রতিটি জাহাজে গড়ে ৩,০০০ মেট্রিক টন পণ্য হিসাব করলেও ৪০০টি জাহাজে আটকে আছে ১২ লাখ মেট্রিক টন পণ্য।
এসব জাহাজের মধ্যে রয়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য, কয়লা, পাথর, সিমেন্ট ক্লিংকার, জিপসাম, ইউরিয়া ফ্লাই অ্যাশ-সহ নানান পণ্য।
লাইটার জাহাজকে ফ্লোটিং ওয়্যারহাউস ( ভাসমান গুদাম) করে রাখার ফলে নির্ধারিত সময়ে বন্দর ছেড়ে যেতে পারছে না মাদার ভেসেল। এর প্রভাবে বন্দরের বহি:নোঙ্গরে বাড়ছে জাহাজের সংখ্যা। বন্দরে জাহাজ অতিরিক্ত সময়ে অবস্থান করায় আকার ভেদে প্রতিদিন একটি জাহাজকে ১৫,০০০ হাজার থেকে ২০,০০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
কন্টেইনার যানজট
শুধু লাইটার জাহাজে খোলা পণ্য পরিবহনেই এই সংকট নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনার পরিবহনেরও দেখা দিয়েছে জট পরিস্থিতি। রমজান ঘিরে আমদানি পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামালের ক্রমশ স্তূপ জমছে বন্দরের ইয়ার্ডে।
গত এক মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে অতিরিক্ত ৪,০০০ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট) আমদানি কন্টেইনার বৃদ্ধি পেয়েছে। রেলপথে পরিবহনের কন্টেইনার সংখ্যাও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এমন পরিস্থিতিতে সরবরাহ শৃঙ্খল ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে রেলওয়েসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বন্দর। ২৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমের সাথেও বৈঠক ডেকেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
লোকসান গুনছেন জাহাজ মালিকরা
লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সাঈদ মাহমুদ জানান, স্বাভাবিক নিয়মে জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করলে যে ভাড়া পেতো, এখন আটকে থাকায় প্রতিটি জাহাজে ১০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির টিবিএসকে বলেন, "কিছু কিছু আমদানিকারক নিজস্ব গোডাউন না থাকা স্বত্বেও পণ্য আমদানি করেন। এসব পণ্য লাইটার জাহাজেই রেখে দেন তারা। এর ফলে এই সংকট তৈরি হয়েছে।"
"এখনও দেশের বিভিন্ন রুটে চার শতাধিক লাইটার জাহাজ পণ্য ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এতে জাহাজের সংকট দেখা দিয়েছে," যোগ করেন তিনি।
আমদানি বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের এলসি নিষ্পত্তির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে দেশে ৯টি ভোগ্যপণ্যের মোট আমদানি হয়েছিল ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৭১৩ টন। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময় আমদানি হয়েছে ১৯ লাখ ১৯ হাজার ৪৫০ টন।
গত অক্টোবর-জানুয়ারি সময়ে আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ছোলার আমদানি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৩৪ শতাংশ, খেজুর ২৩ শতাংশ, চিনি ২০ শতাংশ, ডালজাতীয় পণ্য ৪৪ শতাংশ, রসুন ২০ শতাংশ ও আদা আমদানি ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৪,২০০ বাণিজ্যিক জাহাজ আসে। বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলোর প্রায় ৪৫ শতাংশ কন্টেইনার জাহাজ, ৪৫ শতাংশ বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১০ শতাংশ ট্যাংকার।
প্রায় ৮০ শতাংশ বাল্ক কার্গো লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাইরের নোঙ্গরগুলোয় আনলোড করা হয়, বাকি ২০ শতাংশ আনলোড হয় জেটিতে।
চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ কনটেইনার। অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বন্দরে ৩০,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫,০০০ টিইইউ কন্টেইনার থাকে। গত ২৪ জানুয়ারি এই সংখ্যা ছিল ৩৬,০৬৩ টিইইউ। ডেলিভারি কমে যাওয়ায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেইনার আছে ৪০,০৮৯ টিইইউ। একমাসে বন্দরে কন্টেইনার বেড়েছে ৪,০০০ এর বেশি। ইয়ার্ডে কন্টেইনার বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি।
গত তিনমাসে বন্দরে জাহাজ এবং আমাদনি পণ্য আসার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ৩২৫টি জাহাজে আমদানি পণ্য আসে ৯৯,১৬,১৭৯ মেট্রিক টন। ডিসেম্বরে ৩৪১টি জাহাজে ১,০৫,১৩,৬২৭ মেট্রিক টন আমদানি পণ্য এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৭১টি জাহাজে ১,১৩,৬৭,৮৩০ মেট্রিক টন আমদানি পণ্য এসেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জানুয়ারিতে এসেছে অর্থবছরের সবচেয়ে বেশি জাহাজ এবং আমদানি পণ্য।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলযোগে ঢাকা কমলাপুর আইসিডিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কন্টেইনার রাখার স্লট ৮২৫ টিইইউ। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৭৫৮ টিইইউতে–যা সক্ষমতার দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
একইভাবে বেড়েছে বন্দরের বহি:নোঙ্গরে জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি বন্দরে ওয়ার্কেবল জাহাজের সংখ্যা ৯৩টি, ২৪ জানুয়ারি এই সংখ্যা ছিল ৮৫টি। অর্থাৎ, জাহাজ বাড়ার সংখ্যা ৯ শতাংশের বেশি।
এদিকে, ইয়ার্ডে থাকা কন্টেইনার আগামী ৯ মার্চের মধ্যে খালাস না হলে পরবর্তী দিন থেকে চারগুণ ভাড়া যুক্ত হবে। নতুন আমদানি করা কন্টেইনারের ক্ষেত্রে পঞ্চম দিন থেকে চারগুণ হারে মাশুল আদায় করবে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, একটি ২০ ফুটের একক কনটেইনার নির্ধারিত চার দিনের ফ্রি টাইমের পর প্রথম সাত দিনের জন্য মাশুল আসবে ৬ ডলার এবং ৪০ ফুটের কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ১২ ডলার। পরবর্তীকালে সাত দিনে ২০ ফুটের জন্য আসবে ১২ ডলার ও ৪০ ফুটের ক্ষেত্রে ২৪ ডলার। তৃতীয় সাত দিন থেকে ২০ ফুটের জন্য ২৪ ডলার এবং ৪০ ফুটের জন্য ৪৮ ডলার করে মাশুল গুনতে হয়। এখন বন্দরের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত এসব মাশুলের সঙ্গে চারগুণ হারে ফি আসবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, "যাতে কেউ বাজারে কৃত্রিক সংকট তৈরি করতে না পারে সেজন্য আমরা মাশুল আরোপের নোটিশ দিয়েছি। কন্টেইনার রাখার চারদিন পর থেকে নির্ধারিত মাশুলের চারগুণ জরিমানা করা হবে।"
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক টিবিএসকে বলেন, "সাধারণত একটি জাহাজ গন্তব্যের দূরত্ব অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে আনলোড হওয়ার কথা। তবে গুদাম খালি না থাকলে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে বিলম্ব হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডেমারেজ কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটি জাহাজ মালিক, আমদানিকারকের মধ্যে লিখিত চুক্তির ওপর নির্ভর করে।"
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, "পণ্য পরিবহন নীতিমালা অনুযায়ী, কোনোভাবেই লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এটি বাজারে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত করে। পণ্য পরিবহন নীতিমালার ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা এই মুহূর্তে বিডব্লিউটিসি সেল কিংবা জাহাজ মালিকদের সাথে বৈঠক করতে পারছি না।"