সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ভাতা ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের

আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কয়েকটি কর্মসূচির ভাতা, সুবিধাভোগী ও বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রায় ১০টি ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এছাড়া অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি ও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের অনুষ্ঠানের পর টিবিএসকে বলেন, এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠানোর পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি টিবিএসকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কয়েকটি কর্মসূচির ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে যে পরিমাণ ভাতা দেওয়া হয়, সেটা খুবই কম।'
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শামীমা ফেরদৌস গতকাল (১০ ফেব্রুয়ারি) টিবিএসকে বলেন, 'মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ পর্যাপ্ত কি না বা কোন খাতে কী ব্যয় হয় ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রস্তাব চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।'
বর্তমানে সারা দেশে ৬০ লাখ বয়স্ক নাগরিককে মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। মাসিক ৫৫০ টাকা করে ২৭.৭৫ লাখ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আর ৩২.৩৪ লাখ অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৮৫০ টাকা করে।
এছাড়া হিজড়া, বেদে, চা শ্রমিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা দিচ্ছে সরকার। তাদের ভাতাও বাড়তে পারে।
বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এজন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের ১৭.০৬ শতাংশ।
এই বরাদ্দের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের পেনশন সুবিধা বাবদ ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সহায়তায় ৮ হাজা ৮২৮ কোটি টাকা, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ ৩৪২ কোটি টাকা, চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প বাবদ ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত।
তবে এসব খাতসহ সামাজিক নিরাপত্তার আরও কিছু খাতকে প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তা বলে মনে করেন না অর্থনীতিবিদরা।
সুবিধাভোগী যাচাই-বাছাই চলছে
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের যাচাই-বাছাই হচ্ছে। একই ব্যক্তি একাধিক সুবিধা পাচ্ছেন কি না বা অযোগ্য ব্যক্তি সুবিধা পাচ্ছেন কি না সেটি দেখা হচ্ছে।'
ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই একাধিক সুবিধা পান, আবার অনেক অযোগ্য ব্যক্তি সুবিধা নিচ্ছেন। তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে প্রকৃতপক্ষে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কাঠামোতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ: টাস্ক ফোর্স
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন দিয়েছে অর্থনীতি বিষয়ক টাস্কফোর্স।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর কাঠামোতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই কর্মসূচিগুলো বিচ্ছিন্ন ও অসমন্বিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো একাধিক মন্ত্রণালয়ের আওতায় পরিচালিত হয়, কিন্তু কার্যকর সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে ওভারল্যাপ বা একাধিক কর্মসূচির মাধ্যমে একই সুবিধাভোগীকে সহায়তা দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যা সম্পদের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সৃষ্টি করে।
এতে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বাজেট বরাদ্দ কম এবং এটি সামষ্টিক অর্থনীতির তুলনায় খুবই সীমিত। সুবিধাভোগীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত না করায় অনেক প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তি সহায়তা পান না, আবার কিছু ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত ব্যক্তিরা সুবিধা পেয়ে থাকেন।
টাস্ক ফোর্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী। নগরায়ণের ফলে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচির অভাব রয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অভাবে অনেকে সহজে সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন না। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হন।
'যে ভাতা দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়'
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়।
সরকার একটা ভাতার পরিমাণ নির্ধারণ করে, যেটা অনেক বছর ধরে চলতে থাকে। সেখানে বাজার পরিস্থিতি বা মানুষের জীবনযাপন পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয় না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভাতার পরিমাণ ও সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাভোগী বাড়াতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রায় আড়াই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এ সময়ে মজুরি বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি হচ্ছে, যেখানে মানুষের বিকল্প কাজের সুযোগ নেই বা কম। এর ফলে অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
এজন্য ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও বেশি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এর আগের সরকারের সময়ে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার পাল্টেছে। সরকারের কাজের অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আনতে হবে।