৩৩৫ কোটি টাকা অপচয়ে তৈরি রূপপুরের ভুতুড়ে রেললাইন, যা কোনো গন্তব্যে পৌঁছে না

বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার যে রেললাইন নির্মাণ করেছিল, তা সমাপ্তির পর থেকেই অব্যবহৃত পড়ে আছে। ২০২২ সালে কাজ শেষ হওয়ার পরও এ প্রকল্পটি চালু হয়নি, যা পূর্ববর্তী প্রশাসনের আমলে অপচয় ও আর্থিক অনিয়মের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ২৬.৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেললাইনটি ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন থেকে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
তবে প্রকল্পের পরিকল্পনায় রেললাইন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। রাশিয়ার পরামর্শকদের তৈরি মাস্টার ট্রান্সপোর্টেশন পরিকল্পনায় এ সংযোগের উল্লেখ ছিল না। তবু ২০১৮ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি শুরু করে এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ রেলওয়েকে।
সে সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ছিলেন ইয়াফেস ওসমান, আর রেলমন্ত্রী ছিলেন মো. মুজিবুল হক। ভারত-বাংলাদেশের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিকে ডুয়েল-গেজ রেললাইনটি নির্মাণের চুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
২০২২ সালের জুন মাসে রেললাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়, তবে এখনো সেটি ব্যবহার করা হয়নি। ২০২০ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে প্রকল্পে ৩২১.৬৬ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের তথ্য উঠে আসে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ কিলোমিটার দূরে শেষ রেললাইন
ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন থেকে একটি সাইডিং ও লুপ লাইনসহ রেললাইনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে থেকেই শেষ হয়েছে। কেন্দ্রের সঙ্গে সংযোগের জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে একটি সরু মাটির রাস্তা তৈরি করা হয়েছে, যা ভারী যন্ত্রপাতি বহনের উপযোগী নয়।
রেললাইন নির্মাণে সাতটি কালভার্ট, ১৩টি লেভেল ক্রসিং গেট, একটি 'বি' শ্রেণির স্টেশন এবং একটি স্টেশন প্ল্যাটফর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউরেনিয়াম পরিবহনের জন্য এ রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে।'
কিন্তু সেটি ব্যবহার হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।'
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. জাহেদুল হাসান বলেন, এ রেললাইন কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
কেন এটি নির্মাণ করা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাস্টার ট্রান্সপোর্টেশন পরিকল্পনায় রেললাইন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেন এটি তৈরি করা হয়েছে, তা আমি জানি না।
তিনি আরও জানান, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় পদ্মা নদীর তীরে একটি আন্তর্জাতিক বন্দর স্থাপন করা হয়েছে, যা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
'এ বন্দর দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহন করা হচ্ছে, আর হালকা সরঞ্জাম নেওয়া হচ্ছে আকাশপথে,' বলেন তিনি।
২০২০ সালের আগস্টে চালু হওয়া ১৫০ মিটার বাই ৩৫০ মিটার পদ্মা বন্দরের নির্মাণকাজ দেড় বছরে শেষ হয়। এটি সারা বছর ১০ মিটার গভীরতা বজায় রাখতে সক্ষম। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ ও নভোরোসিয়েস্ক থেকে আসা পণ্য মংলা সমুদ্রবন্দর হয়ে এ বন্দরের মালবাহী টার্মিনালে পৌঁছায়।
রেললাইন উদ্বোধন
রেল পরিবহন পরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, ক্যাসেল কনস্ট্রাকশন (বাংলাদেশ) এবং জিটিপি ইনফ্রাপ্রজেক্টস (ভারত)-এর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তৎকালীন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন সভাপতিত্ব করেন। সেখানে ক্যাসেল কনস্ট্রাকশনের পরিচালক কাজী নাবিল আহমেদ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে মুজিবুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, 'রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমাদের মালবাহী ট্রেনের মাধ্যমে ভারী যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম পরিবহন করতে হবে। তাই নতুন রেল সংযোগ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।'
তিনি আরও বলেন, 'এ রেল সংযোগ রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে, ফলে পণ্য পরিবহন আরও সহজ হবে।'
২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
বিভ্রান্তিকর মূল্যায়ন প্রতিবেদন
রেললাইনটি ব্যবহার না হওয়া সত্ত্বেও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরঞ্জাম পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এটি সরঞ্জাম পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক-২ সাইফুল ইসলাম ২০২৪ সালের জুলাই মাসে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেন।
প্রতিবেদনে রেললাইনটির সুবিধাভোগীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, রূপপুর রেল সংযোগ ভারী যন্ত্রপাতি নিরাপদে ও সহজে পরিবহনের সুযোগ তৈরি করেছে। আরও উল্লেখ করা হয়, আপগ্রেড করা সিগন্যালিং ব্যবস্থা ট্রেন চলাচল ঝুঁকিমুক্ত করেছে এবং উন্নত প্ল্যাটফর্মের ফলে যাত্রীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তবে বাস্তবে এ রেলপথে এখনো কোনো ট্রেন চলেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি প্রকল্প পরিচালকের দেওয়া সরঞ্জাম পরিবহনের একটি নথির ভিত্তিতে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটিতে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ রাখার পরিকল্পনা থাকলেও সেটি এখনো কার্যকর হয়নি। তবে তার এ বক্তব্য তার নিজের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি পরিবহনের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে এবং ঈশ্বরদী জংশনের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। এতে আরও দাবি করা হয়, নিরীক্ষা অধিদপ্তর যে ৩২১.৬৬ কোটি টাকার অসঙ্গতি চিহ্নিত করেছিল, তা সমাধান করা হয়েছে।
যে-সব অসঙ্গতি পাওয়া গেছে
অডিট প্রতিবেদনে রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে আটটি বড় আর্থিক অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুমোদিত বাজেটের তুলনায় প্রকল্প ব্যয় বেশি ধরা হয়েছিল, যার ফলে সরকারের ৪৫.৩২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। ৩,৪৮০ টন রেল ও ২৪,৮২৭টি স্লিপার কেনার জন্য অনুমোদিত বাজেটের তুলনায় ৮০.৭৬ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করা হয়, যা প্রকৃত চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।
নিয়মিত লাইনে ব্যবহারের উপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত ওজনের রেল কেনার পেছনে ১১.৩১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঠিকাদারকে ২৯.৭৫ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়।
অডিট রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, হিসাববিহীন কংক্রিট সঙ্কোচনের কারণে ৮২.৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। রাস্তা বিভাজক নির্মাণে অনুমোদনের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করায় সরকারের ৪২.৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া পরীক্ষা ছাড়াই পাথর ব্যালাস্ট সরবরাহের কারণে ৩ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। পাশাপাশি পরিমাপ বইতে সম্পন্ন কাজের যথাযথ নথিপত্র ছাড়াই ১৫০.২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।