মাধ্যমিকে যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা

২০২৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের কারণে বই ছাপানোর কাজ নির্ধারিত সময়ের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের মতে, নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ও মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) শিক্ষার্থীদের মাঝে ৪০ কোটির বেশি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণের লক্ষ্য রয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্তরের জন্য ১০ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে। তবে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বাকি ৩০ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ এখনো শুরু হয়নি।
এসব চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে, এনসিটিবি এখন প্রত্যেক মাধ্যমিক শিক্ষার্থীকে সাধারণত ১০টি বা তার বেশি বই দেওয়ার পরিবর্তে প্রধান ৫টি বই দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা সাধারণত ১৩টি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মাধ্যমিক স্তরের ১৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর জন্য তহবিল অনুমোদন করা হয়েছে এবং আশা করছি, আগামী সপ্তাহে ছাপানোর কাজ শুরু হবে।"
তিনি আরও জানান, ছাপানোর কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে এক কোটি বই ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "এছাড়া, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির জন্য ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে সম্পাদনার কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা কয়েকটি সংশোধন করেছি, যেমন জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত কিছু গ্রাফিতি অন্তর্ভুক্ত করা।"
এনসিটিবি চেয়ারম্যান আরও বলেন, "ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচটি বই বিতরণের লক্ষ্য রয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা ১ জানুয়ারির মধ্যেই বইগুলো পায়।"
তিনি বলেন, মাধ্যমিকের সব পাঠ্যপুস্তক জানুয়ারির শেষে বিতরণের চেষ্টা চালানো হবে।
তবে, বাংলাদেশ প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান এনসিটিবি চেয়ারম্যানের চেয়ে কম আশাবাদী।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "৩০ কোটি বই ৪৫ দিনের মধ্যে ছাপানো অসম্ভব; কাজটি সম্পূর্ণ করতে আমাদের আরও ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় প্রয়োজন। পাঁচটি বই ছাপানোর অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কিছু কাজের আদেশে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আমরা এনসিটিবিকে আগে জানিয়েছিলাম, কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, "এছাড়া, পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমরা এনসিটিবির সঙ্গে এক পরামর্শ সভায় আমাদের উদ্বেগগুলো জানিয়েছি এবং এতে তারা সম্মতিও দিয়েছেন।
এনসিটিবির উৎপাদন ও বিতরণ শাখার কর্মকর্তারা বুধবার (১৩ নভেম্বর) টিবিএসকে জানিয়েছেন, এই বছর মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তক ৬৮০টি লটে ছাপানো হবে, যা গত বছর ছিল ৪১৭টি। এই পরিবর্তনটি বই ছাপানোর প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে এবং ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমে ফিরে যাওয়ার কারণে দেরি হওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে করা হয়েছে।
তারা আরও জানান, এই পরিবর্তনের ফলে খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। গত বছর ৮২টি প্রিন্টিং প্রেস ব্যবহার করা হয়েছিল, তবে এবার ১০০টি প্রেস ব্যবহৃত হবে।
এই বছর, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এবং আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানের কারণে, ২০২২ সালের পাঠ্যক্রম বাতিল করে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির জন্য ২০১২ সালের পাঠ্যক্রমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বিতরণ শাখার সূত্র অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বুধবার ষষ্ঠ, সপ্তম ও কারিগরি বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর অনুমোদন দিয়েছে।
এনসিটিবি প্রেসগুলোর সাথে চুক্তি চূড়ান্ত করার পর ছাপানোর কাজ শুরু হবে। এদিকে, অষ্টম শ্রেণির টেন্ডার যাচাই প্রক্রিয়া চলছে এবং দশম শ্রেণির টেন্ডার মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) জারি করা হয়েছে। নবম শ্রেণির টেন্ডার আগামী সপ্তাহে জারি হওয়ার আশা রয়েছে।
এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি বছর জুন মাসে বই ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এই বছরও তাই হয়েছে। তবে, সরকার পরিবর্তনের পর পাঠ্যক্রম সংশোধন করতে হয়েছিল।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১২ সেপ্টেম্বর টেন্ডারটি বাতিল করা হয়েছিল। তাই আমাদের হাতে খুব কম সময় আছে, কারণ আমরা আসলে একেবারে নতুন করে শুরু করছি।"
তিনি আরও জানান, "আমরা লক্ষ্য রেখেছি, নতুন বছরের প্রথম দিন মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাঁচটি বই বিতরণ করার। আর বাকি বইগুলো জানুয়ারির শেষের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এজন্য আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে প্রক্রিয়াতে যুক্ত করার অনুমতি নিয়েছি।"
গত বুধবার ক্রয় ও অর্থ বিষয়ক পরামর্শ কমিটির দুটি বৈঠকের পর, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, নতুন বছরের প্রথম মাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা (বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ), দাখিল ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে।
কমিটি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য বাংলা, ইংরেজি এবং কারিগরি বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের অনুমোদন দিয়েছে। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির প্রথম দিকে তাদের পাঠ্যপুস্তক পাবে।
সূত্রমতে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) এবং দাখিল ও কারিগরির ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাশাপাশি ইবতেদায়ির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই শ্রেণিগুলোর ১২.৬৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক ছাপানো, বাঁধাই ও সরবরাহে ব্যয় হবে ৫২৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ৭০টি লটে বই ছাপানোর কাজ চলমান এবং কিছু বই ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। এছাড়াও, এছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং প্রাক-প্রাথমিকের ২৮টি লটের কাজ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের প্রক্রিয়াতে আছে। এক লটে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য ১ লাখ ৯২ হাজার বই ছাপানোর কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি বলেন, "সবমিলিয়ে, আমরা জানুয়ারির প্রথম দিনেই প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সব বই হস্তান্তর করতে পারবো।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারতের কোম্পানিগুলোর জন্য নির্ধারিত ১৮টি লটের কাজ মন্ত্রণালয়ে পুনঃপ্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে। এছাড়া, নন-রেসপন্সিভ [এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি] ১০টি লটের কাজ এখনও পর্যালোচনার মধ্যে রয়েছে।
বর্তমানে দেশের সব প্রেসে বই ছাপানোর কাজ চলছে। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য ৮টি, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির জন্য ৪১টি, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর জন্য ৫৫টি ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি প্রেসে বই ছাপানো হচ্ছে।