ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ অনিশ্চিত, ১০ কোটি বই ছাপানো বাকি

১০ কোটি বই ছাপানো না হওয়ায় ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক বিতরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অবশ্য দাবি করছে, আবশ্যিক বইগুলো ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বিতরণ করা হবে। তবে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের মতে, পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, প্রথম থেকে দশম শ্রেণির মোট ৪০ কোটি পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ এখনো ছাপানো হয়নি। এর মধ্যে ১১ কোটি মাধ্যমিকের বই এবং ১ কোটি প্রাথমিকের বই রয়েছে। এছাড়া, আরও ৪ কোটি মাধ্যমিকের বই বাঁধাইয়ের প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান টিবিএসকে বলেন, সোমবার পর্যন্ত ২৯ কোটি ৩৫ লাখ বই ছাপানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি বই বাঁধাইয়ের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আবশ্যিক বইগুলোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ কোটি বই ছাপানো বাকি রয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বই ছাপানো সম্ভব।
এনসিটিবি-এর উৎপাদক নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বলেন, প্রাথমিকের ৯ কোটি ১৯ লাখ বইয়ের মধ্যে ৮৭.১৬ শতাংশ অর্থাৎ ৮ কোটি ১৪ লাখ বই ইতোমধ্যে ছাপানো ও বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে।
এনসিটিবি-এর বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো: হাফিজুর রহমান বলেন, বোর্ডের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ শেষ করা। "তবে সেটি না পারলেও, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কাজটি শেষ হবে।"
দেরির কারণ
২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো বেশিরভাগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী অ্যাকাডেমিক বছরের প্রথম দিনেই সব পাঠ্যপুস্তক পায়নি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন সময় স্বল্পতা, পুনরায় টেন্ডার প্রক্রিয়া, কাগজের অভাব এবং বাঁধাই সমস্যা।
অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান বলেছেন, "আমাদের নতুন করে টেন্ডার ও পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন করতে হয়েছে, কারিকুলাম বদল করতে হয়েছে। যার কারণে কয়েক কোটি বই অতিরিক্ত ছাপতে হয়েছে। বিশেষ করে দশম শ্রেণীর প্রায় ৬ কোটি বই।"
এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, ভারত থেকে বই ছাপানোর চুক্তি বাতিলের কোনো প্রভাব এই প্রক্রিয়ায় পড়েনি।
কাগজ ও বাঁধাই সংকট সম্পর্কে অধ্যাপক রিয়াজুল বলেছেন, "প্রেসের মালিকদের নানা সুবিধা দেওয়ার পরেও কিছু গড়িমসি ছিল। আমরা তাদের ঋণ প্রক্রিয়া, কাগজ সরবরাহ, বাধাই ম্যানেজমেন্ট এ সহায়তা করেছি। এরপরেও কিছু সংকট থাকলেও দ্রুততার জন্য সক্ষম প্রেসকে আমরা কাজ করতে বলেছি। "
তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, আবশ্যিক পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হবে।
কাগজ সরবরাহের সমস্যার বিষয়ে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান বলেছেন, সরবরাহের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা তাদের সর্বোচ্চ কাজ করতে সক্ষম হবেন। তিনি আরও বলেন, ৮ হাজার টন কাগজ প্রক্রিয়াকরণে সর্বাধিক আট দিন সময় লাগবে, অর্থাৎ এখন আর কাগজের অভাব নেই।
তিনি আরও বলেছেন, বাঁধাই সংকট তৈরি হওয়ায় এনসিটিবি বাঁধাই সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছে, যাতে প্রক্রিয়া দক্ষভাবে তত্ত্বাবধান এবং দ্রুততর করা যায়।
এনসিটিবির উৎপাদন ও বিতরণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই বছর মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তক ৬৮০টি লটে ছাপানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের মাত্র ১৮টি লটের কাজ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে সেটি বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর নতুন করে আর্মি প্রিন্টিং প্রেসকে বই ছাপানোর কাজে যুক্ত করা হয়েছিল। যার কারণে ভারতে বই না ছাপানোতে কোন প্রভাব পড়েনি।
অন্যদিকে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, "এবার প্রেস মালিকরা টেন্ডারের বাইরেও বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে কাজ করেছেন। আমাদের প্রেসের মেশিন ক্যাপাসিটি দৈনিক ৪০০ রিম থেকে ৮০০ রিম করা হয়েছে। আবার বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু শ্রেণির বইকে প্রাধান্য দিয়ে ছাপানো হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এসবের পরেও আমরা কম সময়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে কাগজের দাম টন প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যায়।"
তিনি আরো বলেন, "কাগজ সংকটে এনসিটিবির মধ্যস্ততায় প্রেস মালিকরা ৮ হাজার টন কাগজের অর্ডার দেন। সেই কাগজ আমরা যথাসময়ে পাইনি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে তিন কিস্তিতে কাগজ বুঝিয়ে দিবে। তারা জানিয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির কাগজ পাঠাবে। এই অবস্থায় ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বই ছাপানো অসম্ভব।"
বই ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক (মূল প্রভাতি) মুসতারী সুলতানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট ও টেন-এর অধিকাংশ বই পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ক্লাস নাইন এর বই পাওয়া নিয়ে সংকটে আছে।"
তিনি আরও বলেন, "কিন্তু শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ও বই অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে পড়ানো হচ্ছে। তবে শ্রেণি কার্যক্রমে কোন প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে না।"