জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা: শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন ১৯২ চিকিৎসক, ইন্টার্ন ও শিক্ষার্থী

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া, আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দেশের আটটি মেডিকেল কলেজের অন্তত ১৯২ জন চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিসক ও শিক্ষার্থীকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজগুলোর আন্দোলনপন্থি শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মেয়াদে একডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি, ক্যাম্পাস ও হল থেকে বহিষ্কার ও সম্ভাব্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ এই ১৯২ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
শাস্তির মুখোমুখি হতে যাওয়া এসব চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তালিকায় থাকা ১৯২ জনের মধ্যে চিকিৎসক ১৮ জন, ইন্টার্ন চিকিৎসক ৪৩ জন ও শিক্ষার্থী ১০৮, এবং বহিরাগত চিকিৎসক রয়েছেন ২৩ জন। মেডিকেল কলেজের অফিস আদেশ এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হতে পারে। এসব অফিস আদেশ ও একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের কপি টিবিএসের হাতে এসেছে।
যেসব মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো হলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল), রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ ও ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ফয়সাল আলম টিবিএসকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে কোনো সরাসরি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি, তবে শিক্ষার্থীরা ও সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তারা উপর্যুপরি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান তিনি। সেখানে অভিযুক্তদেরও তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
ফয়সাল আলম আরও বলেন, 'তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে ২০ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তালিকায় না থাকা ছয়জন শিক্ষককে একাডেমিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে; পাশাপাশি তাদের বদলির সুপারিশ করা হয়েছে।'
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে গা-ঢাকা দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও।
পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে অবাছিত ঘোষণা করেন। পাশাপাশি যারা বিভিন্ন সময় ছাত্র নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন, তাদের শাস্তির দাবি জানান।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের বহিরাগত চিকিৎসক, ইন্টার্ন চিকিৎসকসহ ২১ জনের বিরেুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতালের একাডেমিক কাউন্সিল।
গত ২১ আগস্ট অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
১৩ জন বহিরাগত ডাক্তারকে আজীবনের জন্য ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত করা হয়। এছাড়া চার ছাত্রীকে ইন্টার্ন হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানোসহ হেনস্তার অভিযোগে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ১১ শিক্ষকসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সম্প্রতি মেডিকেল কলেজের একামিক কাউন্সিলের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ছয় শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি এবং ৫ শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
এছাড়া ১৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯ জনকে আজীবন হল থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে অবাঞ্ছিত ও হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে ১৫ জন ইন্টার্ন চিকিৎসককেও। তাদের মধ্যে ১২ জন ইন্টার্ন চিকিৎসকের বিভিন্ন মেয়াদে (৬ মাস থেকে ২ বছর ) ইন্টার্নশিপ স্থগিত করা হয়। এদের মধ্যে দুজনকে ক্যাম্পাস এবং ১০ জনকে হল থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ কর হয়।
এছাড়া ছয়জন বহিরাগত চিকিৎসককে ক্যাম্পাসে আজীবনের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
হল দখল, শিক্ষার্থীদেড় নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ২০ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত একাডেমি কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি ও হল থেকে বহিষ্কার কর হয়েছে তাদের।
সম্প্রতি হাসপাতালের প্রিন্সিপাল খন্দকার মো. ফয়সাল আলম স্বাক্ষরিত এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
রংপুর মেডিকেল কলেজ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অফলাইন ও অনলাইনে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার অভিযোগ ১৪ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছে রংপুর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া হোস্টেলে চাঁদাবাজি ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগে দুই শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ১৩ ইন্টার্ন চিকিৎসককে আজীবনের জন্য হোস্টেলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জনকে (৬ মাস থেকে ২ বছর) বিভিন্ন মেয়াদের জন্য ইন্টার্নশিপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. গোলাম ফেরদৌস স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ
চার চিকিৎসককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণার পাশাপাশি বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শের-ই-বাংলা মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানা হয়।
এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বর্ষের ৩৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভবে ক্যাম্পাস ও হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ও হোস্টেলে অবাধ বিচরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।
গত ২৯ আগস্ট হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. এ এফ এম নুরউল্লাহ স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও স্থায়ী আদেশ না আসা পর্যন্ত অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে অবাধ বিচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর
ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের তিন চিকিৎসকসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শাস্তির আওতায় আসা চিকিৎসকদের মধ্যে দুজনের বিএমডিসি সার্টিফিকেট স্থগিত করে মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া মেডিকেলে কলেজের ১৫ শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য ছাত্রাবাস থেকে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন মেয়াদে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার ও ইন্টার্নশিপ স্থগিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।