রাজধানীতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’: দুবাইসহ আরও শহরকে যেভাবে কৃত্রিম উপায়ে শীতল রাখা হয়

চলমান তাপপ্রবাহ থেকে নগরবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দিতে চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের পরামর্শে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে 'কৃত্রিম বৃষ্টি'র ব্যবস্থা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।
ডিএনসিসি'র মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, শনিবার (২৭ এপ্রিল) থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্প্রে-কামান গাড়ি ব্যবহার করে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে এ 'কৃত্রিম বৃষ্টি' তৈরি করবে কর্পোরেশন।
এ দিন আগারগাঁওয়ে পানি ছিটানোর কার্যক্রম পরিদর্শনশেষে মেয়র বলেন, 'চিফ হিট অফিসারের বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। গাড়িগুলো সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি করবে।'
সিটি কর্পোরেশনের এ গাড়িগুলোর প্রতিটির দৈনিক প্রায় চার লাখ লিটার পানি ছিটানোর সক্ষমতা রয়েছে। এতদিন নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতে স্বল্প পরিসরে এ কার্যক্রম চললেও এখন তাপপ্রবাহের মাঝে এ 'বৃষ্টি' কার্যক্রম নিয়মিত চলবে বলে জানান মেয়র।
কৃত্রিম বৃষ্টি যেমন পরিবেশের তাপমাত্রা কমাতে সহায়তা করতে পারে, তেমনি বায়ুদূষণ হ্রাসেও ভূমিকা রাখে এটি। বৃষ্টির পানির ফোঁটার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকা দূষিত কণাগুলো মাটিতে পড়ে যায়।
কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর জন্য বিজ্ঞানীর অনেক আগে থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ জন্য ক্লাউড সিডিং নামক একটি পদ্ধতির ব্যবহার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
তবে এটি নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়। সেই ১৯৪০-এর দশক থেকেই মানুষের ক্লাউড সিডিং নিয়ে ধারণা ছিল। বিশ্বের প্রায় কয়েক ডজন দেশ কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঝরানোর জন্য ক্লাউড সিডিং ব্যবহার করেছে।
খরা রোধে, তাপমাত্রা হ্রাসে ও বায়ুদূষণ কমানোর লক্ষ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, কানাডা, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশ সম্প্রতি ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে বৃষ্টি নামানোর চেষ্টা করেছে।
বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর লাহোরে বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়াশা কমিয়ে আনতে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রথমবারের মতো ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর ব্যবস্থা করে পাকিস্তান।
পরীক্ষামূলক এ উদ্যোগে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী মহসিন নাকবির বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, ক্লাউড সিডিংয়ের ফলে লাহোরের ১০ শতাংশ এলাকায় ওইদিন হালকা বৃষ্টি হয়েছিল।

গত ১৬ এপ্রিল দুবাইয়ে মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ৭৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় চার ইঞ্চি (১০০ মিমি) বৃষ্টিপাতের ফলে মরুভূমির দেশটির বিভিন্ন স্থানে বন্যা দেখা দেয়।
শহরটির পানি নিষ্কাশনের অবকাঠামো সীমিত থাকার কারণে বন্যার পরিমাণ এত তীব্র হয়েছিল যে, দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।
এ বৃষ্টি শুরুর আগে দুবাই ছয়–সাতটি ফ্লাইটে ক্লাউড সিডিং করেছিল। ফলে সন্দেহ করা হয়েছিল, কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের এ চেষ্টাই দুবাইকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্লাউড সিডিংয়ের কারণে দুবাইয়ে এক বছরের বৃষ্টিপাত একদিনে হয়ে যায়নি। আমিরাতের ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজির কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ক্লাউড সিডিং-এর জন্য এ বৃষ্টিপাত হয়নি। এ কৌশলের মাধ্যমে বৃষ্টি ঝরানো সক্ষম হলেও বন্যা তৈরি করার মতো ভারী বৃষ্টিপাত তৈরি সম্ভব নয়।
ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য সিলভার আয়োডাইড, পটাসিয়াম আয়োডাইড বা তরল প্রোপেনের মিশ্রণ মেঘে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ক্রিস্টালগুলো ঘনীভবনকে উদ্দীপিত করে, যা পরে বৃষ্টি ঝরাতে সাহায্য করে। তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে আসলে কতটুকু বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় তা নির্ধারণ করা কঠিন। বিজ্ঞানীরা এর প্রভাব পরিমাপ করতে হিমশিম খাচ্ছেন, কারণ কৃত্রিম পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে কতটুকু বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং প্রাকৃতিকভাবে কতটুকু বৃষ্টি হয়েছে, এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা মুশকিল।
প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত ২০২০ সালের একটি গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে পড়ার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মহলে এখনও এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তাপপ্রবাহের সময় শহরের পরিবেশ অসহ্যকর হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো অপরিকল্পিত নগরব্যবস্থা ও জনবহুল শহরে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অনেক সময় প্রাণঘাতীও হতে পারে। এ বছরের এপ্রিল মাস শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় টানা তাপপ্রবাহ চলছে। এর ফলে হিট স্ট্রোকে রাজধানীসহ সারাদেশে ২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কথা জানা গিয়েছে।
দিনের বেলা শহরের কংক্রিটের অবকাঠামো ও রাস্তার পিচ সূর্যের গরম শুষে নেওয়ার ফলে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। বড় বড় ভবনের ফলে শহরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় গাড়ি ও এয়ার কন্ডিশনার থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত উপাদান।
আশপাশের গ্রামীণ পরিবেশের তুলনায় শহরের তাপমাত্রা কিছুটা বেশি হওয়ার এ বিষয়টি 'আরবান হিট আইল্যান্ড' প্রভাব নামে পরিচিত। এ কারণে গ্রীষ্মকালে বড় বড় শহরকে শীতল রাখার জন্য বাড়তি ব্যবস্থার দরকার হয়। এর জন্য কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর পাশাপাশি আরও কিছু পদ্ধতি রয়েছে।

বলা বাহুল্য, পরিবেশ শীতল রাখার অন্যতম উপায় হলো বেশি করে গাছ লাগানো। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তথ্যমতে, ছায়া দেওয়ার পাশাপাশি গাছের পাতা থেকে নিঃসৃত পানির কণা তীব্র গরমে চারপাশের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি পর্যন্ত কমাতে সক্ষম। ডিএনসিসি'র মেয়র আতিকুল ইসলাম রাজধানীর বাসিন্দাদের প্রতি তাদের বাড়ির আশপাশের গাছের যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গাছ থাকলে সেগুলোর নড়াচড়ার জন্য পর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহের দরকার। কিন্তু শহরের ঘনসন্নিবিষ্ট অবকাঠামোর ফলে এ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শহরের ভবনগুলোর নকশা এমন হওয়া দরকার যেন সেগুলো বাতাসের স্বাভাবিক প্রবাহের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। অবশ্য কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ প্রবাহ নির্ভর করবে স্থানীয় আবহাওয়ার প্যাটার্ন ও ভূতত্ত্বের ওপর।
শহরের ভবনগুলোর ছাদ, সড়কের রংয়ে কালোর প্রভাব বেশি থাকায় এগুলো তাপ শুষে নেয়। বর্তমানে অনেক নগর পরিকল্পনাবিদ ভবনের ছাদে কালোর বদলে হালকা কোনো রং বা আরও বেশি প্রতিফলক পদার্থ ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। শহরে সবুজায়ন বাড়ানো এবং ভবনে তাপ প্রতিফলক উপাদান ব্যবহারের সুফলের তাত্ত্বিক প্রমাণও পাওয়া গিয়ে বিভিন্ন গবেষণায়। অবশ্য এর কার্যকারিতাও শহরভেদে ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশে এ বছরের তাপপ্রবাহ সময়ের ব্যাপ্তি ও প্রভাব-অঞ্চলের দিক থেকে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশে গ্রীষ্মকাল আগের চেয়ে আরও বেশি অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
দ্য রিজিয়নাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি-হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম ফর আফ্রিকা অ্যান্ড এশিয়া (রাইমস)-এর আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ খান মো. গোলাম রব্বানী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তামনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতি বছরের তাপমাত্রা তার আগের বছরের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমা বা জলবায়ু পরিবর্তনে হঠাৎ বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের আশু কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা সামলানো নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। প্রয়োজনে এর জন্য গতানুগতিক পদ্ধতির পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
এ ধরনের একটি ব্যবস্থা হচ্ছে শহরে কুলিং স্টেশন স্থাপন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক শহরই বর্তমানে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য পাবলিক কুলিং স্টেশন স্থাপন করছে। এগুলো মূলত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ভবন যেখানে অবস্থান নিয়ে তীব্র গরমে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে শীতল করতে পারেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গরমের বিরুদ্ধে শীতাতপনিয়ন্ত্রণের মতো খরুচে ব্যবস্থার আয়োজন সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে এ ধরনের পাবলিক কুলিং স্টেশন নিদেনপক্ষে পথচলতি মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য একটু আরাম দিতে পারবে।