১১ মাস ভাতা পাননি মুক্তিযোদ্ধা, জবাব নেই কারো কাছে

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়মিত সম্মানী ভাতা প্রাপ্তদের একজন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ঘোষেরকান্দি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা প্রাপ্তির আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ভাতা পেয়ে আসলেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত, মোট ১১ মাস কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই ভাতা পাননি তিনি।
এমনকি নির্দিষ্ট এই সময়ে কেন তিনি ভাতা পাননি, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার চেষ্টা করলেও আজ অবধি এর কারণ জানতে পারেননি এই মুক্তিযোদ্ধা।
বিষয়টিকে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য অসম্মানজনক উল্লেখ করে স্থানীয় অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা এভাবে তার সম্মানী ভাতা নিয়ে এ ধরনের হয়রানির শিকার হবেন, এমনকি বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েও তিনি এর উত্তর পাবেন না, এটি একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য অসম্মানজনক।
বর্তমানে দেশের বাহিরে অবস্থান করা ভুক্তভোগী এই মুক্তিযোদ্ধা বলছেন, বিষয়টি রীতিমতো হয়রানির ও অসম্মানের। কারণ একেতো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভাতা তিনি পাননি, তাছাড়া সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে ঘুরেও এই ভাতা না পাওয়ার কারণও আজ অবধি জানতে পারেননি তিনি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এর সঠিক জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কাপাসিয়া উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. বজলু বলেন, "সালাউদ্দিনের ভাতা না পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা বলেছি। এতদিনে বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিত ছিল।"
এর আগে, মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনের করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ওই সময়ের ১১ মাসের ভাতা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক বিতরণ করা হয়েছে। কাজেই কোনো একটি চক্র এই ভাতার টাকা আত্মসাৎ করে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
যদিও কোনো মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার টাকা কারো আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম গোলাম মোরশেদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ওনার (মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন) নথিপত্র ঘেটে যতদূর দেখতে পাচ্ছি ২০১৯ সালে জেলা কমিটি উনিসহ নতুন ৩ জনের ভাতার আবেদন অনুমোদন করেন। সে সময় যিনি সমাজসেবা কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি ইতোমধ্যে বদলি হয়ে গিয়েছেন এবং বর্তমানে যিনি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, সম্ভবত সেই সময়ে ৩ জনের মধ্যে ২ জনের বরাদ্দ এসেছিল, একজনের আসেনি।"
"এখন আমরা নথিপত্র ঘেটে বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করছি। আমি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি, যাচাই-বাছাই শেষে আসলে বলা যাবে ঠিক কী হয়েছিল বা কোথায় সমস্যা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, ব্যাংক স্টেটমেন্টে মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনের ১১ মাসের ভাতা না পাওয়ার এই বিষয়টি স্পষ্ট হলেও ২০২১ সালের অক্টোবরে তার করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় লিখিতভাবে জানিয়েছে, '১১ মাসের সম্মানি ভাতা গাজীপুর জেলা প্রশাসক/উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক বিতরণ করা হয়েছে বিধায় এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় নেই।'
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, "যখন ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখে জানতে পারলাম যে ওই ১১ মাসের সম্মানি ভাতা আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি, তখন থেকে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরেই আমি যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউই এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। মন্ত্রণালয় বলছে টাকা বিতরণ করা হয়েছে, অথচ আমি সেই টাকা পাইনি, তাহলে টাকা কার কাছে গেলো?"
"আমার ধারণা একটি চক্র রয়েছে, যারা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা এভাবে আত্মসাৎ করে থাকে, কারণ মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে আমার ১১ মাসের ভাতা বিতরণ করা হয়েছে। অথচ আমি যে ভাতা পাইনি তার প্রমাণ তো ব্যাংক স্টেটমেন্টেই রয়েছে", যোগ করেন তিনি।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দায়ীদের শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
তার এর কাছ থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, এই মুক্তিযোদ্ধার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে 'উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন কমিটি'র এক সভায় নতুন ভাতার আবেদনকারীদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পর সুপারিশসহ তা জেলা কমিটির কাছে পাঠায় উপজেলা কমিটি।
পরবর্তীতে একই বছর ডিসেম্বরে এক সভায় জেলা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান কমিটির অনুমোদন ও সিদ্ধান্তের পর নতুনভাবে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা প্রাপ্তির আবেদন মঞ্জুর করা হয়, যার মধ্যে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নামও রয়েছে।
সেই সময় থেকে পরবর্তী সময়ে নিয়মিত ভাতা প্রাপ্তির এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভাতা বন্ধ হয়ে যায় মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের।
সোনালী ব্যাংকের গাজীপুর শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০ সেপ্টেম্বরে সেখানে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।
২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে ৮ জুন ২০২২ পর্যন্ত তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট বলছে, ওই বছরের ৮ অক্টোবর একসাথে ২০১৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের ২৪ হাজার টাকা ভাতা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।
পরের দফায় ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তার অ্যাকাউন্টে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ হাজার টাকা ভাতা জমা হয়। কিন্তু এর মধ্যবর্তী সময়ে তার অ্যাকাউন্টে আর কোনো টাকা জমা হয়নি। এমনকি এই মুক্তিযোদ্ধার দাবিকৃত ১১ মাসের কোনো টাকা জমা হওয়ারও তথ্য নেই স্টেটমেন্টে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমআইএস এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান করা হয়। এর আগে, এটি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হতো। সে সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ছিলেন উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদান কমিটির সদস্য সচিব, আর সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের ভাতা না পাওয়ার সময়কালের একটি অংশ ম্যানুয়াল পদ্ধতির সময়ের আওতায় পড়েছে। এ বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
কাপাসিয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন টিবিএসকে বলেন, "আগে সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান করা হলেও, এই দায়িত্ব ব্যাংকের কাছে যাওয়ার পর এ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র-ফাইল সংশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক এই কমিটির বর্তমান সদস্য সচিব। আমাদের কাছে বর্তমানে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।"
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের কাপাসিয়া শাখার ব্যবস্থাপক ইন্দ্রজিৎ কুমার সরকার টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিষয়টি জানার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সালাউদ্দিনের যেই ফাইল রয়েছে, এমআইএস এ তার যেই তথ্য রয়েছে, সেগুলো ঘেটে দেখেছি। কিন্তু সেখানে তার এই ভাতা না পাওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, কাজেই এটি কেন হয়েছে সেটি আমরা বলতে পারছি না।"
এদিকে, এ বিষয়ে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করে, এমনকি বিষয়টির বিস্তারিত জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ সফিকুল ইসলামের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (বাজেট) এ এইচ এম মহসীন রেজা টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন কারণে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বন্ধ হয়ে থাকতে পারে। তবে এমন হয়ে থাকলে তা কেন হয়েছে, সেটি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র না দেখে বলা সম্ভব নয়। নথিপত্র দেখলে সেটি জানা যাবে।
সময় নিয়ে নথিপত্র ঘেটেও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বিতরণের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি– বিষয়টি উল্লেখ করলে এই কর্মকর্তা বলেন, "মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেন জানাতে পারেননি সেটি তারাই ভালো জানবেন। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা বরাদ্ধ হলে সেটি সরাসরি তাকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হয়, কাজেই কারো পক্ষে এই টাকা আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই।"