বিশ্লেষণ: ডিএসএ বা সিএসএ, ভয়ে এখনো আঙুলের ডগা অসাড় হয়ে আসে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে (ডিএসএ) সাইবার নিরাপত্তা আইনের (সিএসএ) মাধ্যমে প্রতিস্থাপনকে পুরোনো কিছু ঘষেমেজে নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টাই মনে হচ্ছে। এই পদক্ষেপ আমাদের ভার্চুয়াল জগতে মুক্তমত প্রকাশের দ্বিধা, শঙ্কাকে দূর করতে সামান্য ভূমিকাই রাখবে।
২০১৮ সালে ডিএসএ নিয়ে আসার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপির শাসনামলে পাস হওয়া তথ্য ও প্রযুক্তি আইন (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর বিতর্কিত ৫৭ ধারা বদলানো।
মোটামুটিভাবে বললে, ৫৭ ধারায় মিথ্যা এবং অশ্লীল বিষয়বস্তু অনলাইনে প্রকাশ করাকে বেআইনি করা হয়েছে। এছাড়াও অন্যদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অসৎ হতে প্রভাবিত করতে পারে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে পারে বা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে এমন তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করাকে বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য করা হয়েছিল।
২০১৩ সালের সংশোধনীর আগে এই ধারায় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা। এছাড়া আইনের আওতায় যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেপ্তার করতে- পুলিশকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো।
সংশোধনীর পর সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর করা হয়। আর বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
এই আইনের অপব্যবহার ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। একসময় সরকার ধারাটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আসে। ডিএসএ-তে পৃথক পৃথক ধারা করে হলেও ৫৭ ধারার মূল বিষয়বস্তুগুলো রেখে দেওয়া হয়। তবে আইন নিয়ে ভয় কমার মতো খুব কম উপাদানই ছিল ডিএসএ-তে। এটি আরো বেশি সেল্প-সেন্সরশিপ এবং মামলা দায়েরের দিকে পরিচালিত হয়। অনলাইনে প্রকাশ করা বিষয়বস্তু অবৈধ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে-এমন ভয় তৈরি হয়।

মানবাধিকার কর্মীরা বারবার উল্লেখ করেছেন যে কীভাবে ভিন্নমত দমন করতে ডিএসএ ব্যবহার করা হয়েছিল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শুধু ক্ষুণ্ন করা হয়নি, প্রকৃতপক্ষে এটিকে অপরাধ করা হয়েছে।
নতুন-প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (সিএসএ) এর থেকে আলাদা কিছু বলে মনে হচ্ছে না।
কয়েকটি ধারায় শাস্তি শিথিল করা হয়েছে এবং কিছু অপরাধ জামিনযোগ্য হয়েছে। তবে বাকস্বাধীনতার বিষয়টি অস্পষ্ট রাখা হয়েছে, অনেক সময়েই যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আর এটিই সবচেয়ে উদ্বেগজনক।
শাস্তির পরিমাণ পরিবর্তন খানিকটা স্বস্তি আনলেও এটি আতঙ্ক এবং স্ব-সেন্সরশিপ কমাতে খুব কমই সুযোগ দেবে। যা দেশে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের অংশ হয়ে উঠেছে।
সিএসএ সাইবার জগতে মানুষের আচরণ পরিবর্তন ও নজরদারির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে।
ডিএসএ-এর ধারা-২৮ (৩) এ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রসঙ্গ রয়েছে। ঠিক কোন বিষয়গুলো কারো ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে তা বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
একই ধারাটি প্রস্তাবিত সিএসএ-তে রয়ে গেছে। যদিও এটিকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছর থেকে ২ বছরে কমিয়ে আনা হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তনগুলোর একটি হল মানহানি মামলায় জেলের সাজা বাতিল করা।

ডিএসএ-এর ধারা ২৯ (১) অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্যের প্রকাশ কিংবা প্রেরণে জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
সিএসএ-তে জেলের বিধান বাতিল করা হবে। তবে সর্বোচ্চ জরিমানা পাঁচ গুণ বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হবে।
এছাড়া ডিএসএ-এর ৩২ (২) অনুযায়ী, কেউ যদি ডিজিটাল ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রেরণ করে যা 'বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা শত্রুতা সৃষ্টি করে... সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে বা অশান্তি সৃষ্টি করে...' তাহলে তার সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড হবে। এই ধারায় অপরাধ জামিন অযোগ্য।
সিএসএ-তে কারাদণ্ডের মেয়াদ কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে এবং অপরাধটি এখন জামিনযোগ্য। তবে এখানে উল্লেখিত 'অপরাধ' গুলো বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ আছে। তাই অপব্যবহার হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই কারাদণ্ডের মেয়াদ কমানো হয়েছে। যদিও ধারার ভাষা কমবেশি একই রাখা হয়েছে।
তবে বারবার অপরাধের জন্য ক্রমবর্ধমান কঠোর শাস্তি কিছু ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। এছাড়া কিছু অপরাধ — যেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে জামিন-অযোগ্য ছিল — এখন জামিনযোগ্য হয়েছে।
তবে আইনটি পাস হওয়ার পর কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।

জুনে সংসদীয় অধিবেশনে বক্তৃতাকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে এ বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ৭,০০১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ, জানুয়ারিতে তাদের অনুসন্ধানে প্রকাশ করেছে যে ডিএসএ-এর অধীনে করা ২ শতাংশ অভিযোগ আদালতে উঠেছে। এর অর্থ হল অভিযুক্তদের বেশিরভাগই কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন- অবশ্যই এটি এক ধরনের হয়রানি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে আলাপকালে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, 'পুরোনো আইনের সব বিধান নতুন আইনে রাখা হয়েছে, কেবল শাস্তি ও জামিনের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এটাকে নতুন মোড়কে পুরাতন নিবর্তনমূলক আইন বলবৎ রাখা বলা যায়।'
'বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা ও মানাধিকার সংগঠনগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। কেউ কেউ আইনটির নিবর্তনমূলক ধারাগুলো বাতিলের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু কোনোটিই আমলে নেয়নি সরকার,' তিনি আরও বলেন।
'যেহেতু আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তাই নাম পরিবর্তন করে সরকার বিদেশি সংস্থা, দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ নাগরিকদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে — যাতে তারা আগের আইন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে।'

এ মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, আগের আইনে গ্রেপ্তার বা তল্লাশির ব্যাপক ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া আছে, যেটির কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেছেন, 'শুধু একটি বা দুটি ক্ষেত্রে সাজা হ্রাস করা হয়েছে। এছাড়া, দ্বিতীয় অপরাধের জন্য দ্বিগুণ শাস্তির বিধান বাতিল করা হয়েছে।'
'কিন্তু যারা এ আইনের অপব্যবহারের শিকার হন, তাদের আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। আগে সাত বছরের জেল হতো, এখন তিন বছরের জেল হবে,' বলেন তিনি।
আইনটি সম্পর্কে মৌলিক আপত্তিসমূহ এখনও রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট এ আইনজ্ঞ। 'অপমান' এবং 'মানহানির' মতো বিষয়গুলোকে দেওয়ানি আইনে বিচার করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ ধরনের মামলা ফৌজদারি আইনে বিচার করা হচ্ছে। এটি একটি বড় আপত্তির জায়গা। এ ক্ষেত্রগুলো পরিবর্তন করা হয়নি।'
রাষ্ট্র যেহেতু সাইবার জগতে মানুষের আচরণ নজরদারি করছে, তাই একবার নিজের দিকে আয়না ঘুরিয়েও তাকালেই পারে। দেখতে পারে এটা নিজের উপর প্রতিফলিত হলে কেমন লাগে।
জাতিসংঘ ইতিমধ্যে সাইবারস্পেসে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় আচরণের জন্য একটি নিয়ম তৈরি করেছে। ১২ টি নিয়মের মধ্যে একটি মানবাধিকার এবং গোপনীয়তাকে সম্মান করার সাথে সম্পর্কিত।
নিয়মে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে 'আইসিটি-এর নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রগুলিকে ইন্টারনেটে মানবাধিকারের প্রচার, সুরক্ষা এবং উপভোগের জন্য মানবাধিকার কাউন্সিলের রেজোলিউশন, সেইসাথে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবগুলিকে সম্মান করা উচিত। ডিজিটাল যুগে গোপনীয়তার অধিকারে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারসহ মানবাধিকারের প্রতি পূর্ণ সম্মানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এই রেজোলিউশনগুলি ইন্টারনেট এবং অন্যান্য প্রযুক্তিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারসহ অন্যান্য মানবাধিকার প্রচার ও উপভোগে সুরক্ষা দেয়।
সরকারকে এই নিয়মগুলি মেনে চলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা করা হয়েছে নাকি হয়নি তা বেশ স্পষ্ট।